<p>বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কর্মস্থান,পরিবার ও সমাজে মানুষ তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে, এটা একটা অনিবার্য  ঘটনা হলেও বেশির ভাগ মানুষ এটাকে এত সহজে মেনে নিতে পারে না। একদিকে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে নিজের অন্তর্দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে সমাজের অবাস্তব মানদণ্ডে প্রিতিনিয়ত নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চাপ—এই দুইয়ে মিলে ব্যক্তি মাত্রই এই বিষয়ে এক ধরনের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যায়।</p> <p>আর নারী হলে তো সমাজ এই বিষয়ে আরো কয়েক ধাপ বেশি ক্রূর। একটা নির্দিষ্ট বয়সীমা পার করলেই এই ভোগবাদী সমাজ নারীদেরকে এমনভাবে বাতিলের খাতায় নিয়ে যায়—যেন বয়স হওয়ার মতো একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও আবশ্যম্ভাবিক ঘটনা কোনো গুরুতর অপরাধ। </p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="বই পড়ে কী লাভ, বিজ্ঞান কী বলে?" height="66" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/11/10/1731230775-4321837cd2457df44a49b7d9ad1f9978.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>বই পড়ে কী লাভ, বিজ্ঞান কী বলে?</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/science/2024/11/10/1444958" target="_blank"> </a></div> </div> <p>৭৭তম কান ফিল্ম ফেস্টিভাল, ২০২৪-এ বেস্ট স্ক্রিনপ্লের অ্যাওয়ার্ড উইনিং হলিউডের নতুন চলচ্চিত্র ‘দ্যা সাবস্ট্যান্স' একটা গভীর ফেমিনিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে বয়স্ক নারীদের প্রতি সমাজের এই মনোভাব নিয়ে একটা তীক্ষ্ণ সমালোচনা উপস্থাপন করেছে। এই হরর-সায়েন্স ফিকশন ছবিটি আমাদের সমাজে প্রচলিত সৌন্দর্যের মিথ এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বক্তব্য তুলে ধরেছে।</p> <figure class="image"><img alt="দ্য সাবটেন্সের একটি দৃশ্যে ডেমি মুর" height="337" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/17/my1182/75140049007-the-substance-still-06.jpg" width="600" /> <figcaption>দ্য সাবস্ট্যান্সের একটি দৃশ্যে ডেমি মুর</figcaption> </figure> <p>সিনেমাটিতে দেখা যায় ৫০ বছর বয়সী এলিজাবেথ স্পার্কল (ডেমি মুর), যিনি একজন প্রাক্তন অভিনেত্রী, এখন টেলিভিশনে এরোবিক্স ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেন। ৫০তম জন্মদিনে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এটা প্রমাণ করে যে বয়স্ক নারীদের জন্য এই ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো ভবিষ্যৎ নেই।</p> <p>পরবর্তী সময়ে একটি ব্ল্যাক মার্কেট ড্রাগ ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’- এর মাধ্যমে এলিজাবেথ নিজের একটি তরুণ সংস্করণ সৃষ্টি করেন (সু —মার্গারেট কোয়ালি)। এই দ্বৈত অস্তিত্বের মাধ্যমে পরিচালক করালি ফারগেট আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন—তারুণ্য  ও সৌন্দর্যের প্রতি সমাজের অন্ধ মোহ, বয়স্ক নারীদের প্রতি সামাজিক অবহেলা, হলিউডের তথা সমগ্রিক তারকা ব্যবস্থায় নারীদেহের বস্তুগত ব্যবহার।</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="বই পড়লে কি বুদ্ধি বাড়ে, বিজ্ঞান কী বলে?" height="66" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/10/10/1728559338-fa2d68a654296f5680e8c4d469b866db.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>বই পড়লে কি বুদ্ধি বাড়ে, বিজ্ঞান কী বলে?</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/science/2024/10/10/1433807" target="_blank"> </a></div> </div> <p>এ ছাড়া সমাজে সামগ্রিক স্তরে নারীদেহের এ রকম অবজেক্টিফিকেশন যে তাদের মধ্যে নানান জটিল মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে, তা খুব সুচারুভাবে চিত্রায়িত হয়েছে বিভিন্ন আলোচিত মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আলোকে।</p> <p>ফরাসি মনোবিজ্ঞানী জ্যাক ল্যাকানের ‘মিরর স্টেজ’ তত্ত্ব বলে, শিশু যখন প্রথম আয়নায় নিজেকে দেখে, তখন থেকেই শুরু হয় ‘আমি’ বোধের জন্ম। বড় হয়েও এই আয়নার সামনে দাঁড়ানো চলতে থাকে, যেখানে আমরা নিজেদের দেখি, সাজাই, খুঁজি।</p> <p>আমরা প্রতিদিন আয়নার সামনে দাঁড়াই। বাইরে থেকে মনে হয় যেন শুধু নিজের চেহারা দেখছি, কিন্তু আসলে আমরা আয়নার প্রতিবিম্বের মাঝে নিজের একান্ত গোপন সত্ত্বটার সন্ধান করে চলি। একজন অফিসকর্মী নতুন স্যুটে নিজেকে দেখেন-খুঁজে ফেরেন তার আত্মবিশ্বাসকে, একজন মা নতুন কাট করা চুলে আয়নার সামনে দাড়ান-খোঁজেন পরিবারের নানা কর্তব্যের তলায় চাপা পড়া সেই পুরনো আমিকে, আর সদ্য কিশোরী মেয়েটি যেদিন প্রথম শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়–এক অসীম মুগ্ধতায় নিজেই হারিয়ে যায় নিজের প্রতিচ্ছবির মাঝে। এলিজাবেথও তা-ই করেন—আয়নায় খোঁজেন হারানো তারুণ্য । সু যেন সেই প্রতিচ্ছবিরই মূর্ত রূপ।</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="বই পড়া ক্ষতিকর!" height="66" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/10/14/1728904674-d401977f80d645d5e4eb84841a360ac5.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>বই পড়া ক্ষতিকর!</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/science/2024/10/14/1435063" target="_blank"> </a></div> </div> <p>ট্রমা স্টাডিজের নেতৃস্থানীয় তাত্ত্বিক ক্যাথি ক্যারুথের ‘আনক্যানি’ তত্ত্বে বলা হয়—কখনো কখনো পরিচিত জিনিসও অপরিচিত মনে হয়। এই অনুভূতি আমাদের মনের গভীরে নাড়া দেয়।</p> <p>যেমন অতীতের ছবি দেখলে নিজেকে চেনা যায় না। পুরনো ফেসবুক প্রোফাইল, দশ বছর আগের ভিডিও, কিংবা জীর্ণ ডায়েরির পাতা—সবই যেন অচেনা লাগে আমাদের কাছে। এলিজাবেথের কাছে সু তেমনই—নিজেরই তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি, তবু কত দূরের।</p> <p>সুইস মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কার্ল গুস্তাভ ইয়ুংয়ের ‘শ্যাডো’ তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটি অবদমিত বা লুকানো সত্ত্বা থাকে, যা সমাজের চাপে দমিত থাকে। যেমন—ব্যস্ত মায়ের মনে মডেল হওয়ার স্বপ্ন, অফিসের নীরব কর্মীর মনে রক স্টার হওয়ার বাসনা বা গৃহবধূর গোপন লেখনী। এখানে সিনেমাটিতে প্রদর্শিত সু হল এলিজাবেথের সেই গোপন সত্তা—যা অবাধ, অসীম সম্ভাবনাময়।</p> <p>লেখক ও মনোবিশ্লেষক মেলানি ক্লাইনের ‘স্প্লিট অব্জেক্ট’ তত্ত্ব মতে, মানুষের মন একই বস্তু বা ব্যক্তিকে দুই বিপরীত দৃষ্টিতে দেখে—একদিকে ভালোবাসা, অন্যদিকে ঘৃণা।</p> <p>মানুষের সম্পর্কে ভালোবাসা-ঘৃণা পাশাপাশি থাকে। মা মেয়ের সাফল্যে গর্বিত, আবার স্বাধীনতায় উদ্বিগ্ন। এক বন্ধু অন্য বন্ধুর প্রমোশনে খুশি, আবার ঈর্ষান্বিত। এমনকি নিজের শরীরকেও আমরা কখনো ভালোবাসি, কখনো ঘৃণা করি। এখানে এলিজাবেথ-সুর সম্পর্কেও সেই টানাপড়েন দেখতে পাওয়া যায়। কেমন যেন জটিল এবং পরস্পর-বিরোধী।</p> <p>অস্ট্রিয়ান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ উইলহেম রেইচের  ‘বডি সাইকোলজি’ তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষের মানসিক অবস্থা শারীরিক লক্ষণে প্রকাশ পায়।</p> <p>মনের যন্ত্রণা শরীরে ধরা পড়ে। পরীক্ষার আগের পেট খারাপ, প্রেজেন্টেশনের সময় হাত কাঁপাকাঁপি, দুশ্চিন্তায় অনিদ্রা—সবই তার প্রমাণ। সিনেমাটির শেষ দৃশ্যে দেখানো এলিজাবেথের শারীরিক বিকৃতিও তার মানসিক যন্ত্রণারই প্রতিফলন। </p> <p>আবার জ্যাক লাকানের ‘দ্য রিয়েল’ তত্ত্ব বলে, বাস্তবতা কখনোই আমাদের কল্পনার মতো পরিপূর্ণ হয় না। বাস্তব আর কল্পনার এই দূরত্ব থেকেই জন্ম নেয় মানসিক দ্বন্দ্ব।</p> <p>জীবনে এমন সব মুহূর্ত আসে যখন আমাদের আকস্মিক স্বপ্নভঙ্গ হয়। প্রথম চাকরি স্বপ্নের মতো হয় না, প্রবল প্রেমের রোমান্স বিয়েতে এসে ম্লান হয়ে যায়, পারফেক্ট প্যারেন্টিং অধরাই থেকে যায়। এলিজাবেথও শেষে বুঝতে পারেন—তারুণ্যকে ধরে রাখতে গিয়ে তিনি নিজেকেই হারাচ্ছেন।</p> <p>আমাদের জীবন বহুমাত্রিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন স্বাভাবিক। নিজের সব রূপকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই আসে শান্তি। বাইরের চাপে নিজেকে বদলাতে গেলে মানুষ হারিয়ে যায় তার নিজস্ব সত্তা  থেকেই। প্রতিটি বয়সের সৌন্দর্য অনন্য—এই সত্য উপলব্ধি করলেই জীবন সহজ হতে পারে।</p> <p>‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। প্রত্যেকের মধ্যেই বাস করে একজন এলিজাবেথ—যিনি সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করেন, আর একজন সু—যিনি আমাদের মনের গহীনে জমা রাখা অপূর্ণ স্বপ্নের প্রতীক।</p>