<p>নন্দিত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন। লালন সাঁইয়ের গান তিনি পৌঁছে দেন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। সেই সুবাদে পেয়েছেন অগণিত সংগীতপ্রেমীর ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে পুঁজি করে গানে গানে তিনি পেরিয়েছেন পাঁচ দশকের পথ। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা ও শিল্পীজীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন কালের কণ্ঠের সঙ্গে। জীবন্ত এই কিংবদন্তির কথা শুনেছেন সুদীপ কুমার দীপ।</p> <p>নন্দিত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীন। লালন সাঁইয়ের গান তিনি পৌঁছে দেন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে। সেই সুবাদে পেয়েছেন অগণিত সংগীতপ্রেমীর ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে পুঁজি করে গানে গানে তিনি পেরিয়েছেন পাঁচ দশকের পথ। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমা ও শিল্পীজীবনের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন কালের কণ্ঠের সঙ্গে। জীবন্ত এই কিংবদন্তির কথা শুনেছেন সুদীপ কুমার দীপ।</p> <p><strong>দিনকাল কেমন কাটছে আপনার?</strong></p> <p>এমনিতে ভালো আছি। ঋতু পরিবর্তনের ফলে একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। বছরের এ সময়টাতে কণ্ঠশিল্পীদের সচেতন হয়ে চলতে হয়। যেকোনো সময় ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। আমারও সেটা হয়েছে। তার ওপর ডেঙ্গুর মৌসুম। ভয় পাচ্ছি কিছুটা। মাঝখানে তো করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হয়েছিলাম। সবার দোয়া ছিল বলেই ফিরতে পেরেছি, গাইতে পারছি।<br />  <br /> <strong>লালনপ্রেমীদের কাছে আপনি ‘লালনকন্যা’। এ পরিচয়টা কেমন লাগে?</strong></p> <p>অনেক গর্ববোধ করি। আমার হয়তো গাড়ি-বাড়ি নেই। অনেক টাকা-পয়সাও নেই। তবে একটা নিজস্বতা আছে, সত্তা আছে—যেটা তৈরি করতে পেরেছি। জীবনের শুরুতে ভেবেছিলাম, যদি রেডিওতে গাইতে পারতাম! সেটা হলো। এরপর টেলিভিশনেও গাইতে শুরু করলাম। বিদেশে গিয়ে গাওয়ার সুযোগ এলো। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জাপান, আমেরিকা, লন্ডনসহ বিশ্বের অনেক দেশে গিয়ে গান শোনানোর সুযোগ পেলাম। এটা অনেক গর্বের। এশিয়ার নোবেলখ্যাত ‘ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচারাল’ পুরস্কার পেয়েছি। এই পুরস্কার কিন্তু আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস স্যারও পেয়েছেন। এ ছাড়া একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা পেয়েছি।</p> <p><strong>এখন যাঁরা লালনগীতি গাইছেন, তাঁদের শোনেন? কেমন লাগে?</strong></p> <p>লালন ভাববাদী গান, আত্মস্থ করে গাইতে হয়। ভালো গলা হলেই ভালো গাইবে এ রকম কথা নেই। সংগীত আদিকাল থেকেই গুরুমুখী বিদ্যা। তবে সঠিক গুরু নির্বাচন করতে হবে আগে। অনেকে চিৎকার করে লালন গান করেন, অথচ সেই চিৎকারে মায়া নেই, আবেগ নেই। তাহলে কিভাবে হবে? সাদা কাপড় পরে সাধু সেজে লালনগীতি গাইলেই তো সে সাধক হয়ে যায় না। লালনের ভাব, গানের কথার মানে বুঝতে হবে। ভেতর থেকে অনুভব করে তবেই গাইতে হবে। চিৎকার করে লালনগীতি গাইতে হবে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে অনেকের। সঠিক উচ্চারণটাও করে না তারা। গাওয়ার সময় মাইক্রোফোনটা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটাও জানে না অনেকে। অনেকে তো গুরু সেজে ভাব-বেশ ধরে বসে আছেন। অথচ সঠিক শিক্ষাটা অনুসারীদের দিতে পারছেন না। ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘অচিন পাখি’ নামে একটা সংগীত একাডেমি করেছি। নিজেই সেখানে শেখানোর চেষ্টা করি। এই সময়ের শিল্পীদের অনেক বলেছি, ‘অচিন পাখি’র দরজা খোলা, তোমরা এসো। আমিই শেখাব। কিন্তু কারো আগ্রহ নেই।</p> <p><strong>লালনগীতি বা লোকগান মানেই আমরা বুঝি একতারা, দোতারা, সেতার, মন্দিরা, তবলার ব্যবহার। এখন তো কি বোর্ডের মাধ্যমেই এ ধরনের গান করছেন শিল্পীরা...</strong></p> <p>আমি কি বোর্ডের বিপক্ষে নই। কি বোর্ড সাপোর্ট হিসেবে থাক না। তবে লালনগীতি বা ফোক গানের সঙ্গে একতারা, দোতারা তো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেটা ছাড়া তো গানগুলো অপূর্ণ রয়ে যাবে। এখন কথা হলো, বেসুরো একতারা বাজালে কি আমি তার সঙ্গে গাইব? না। আমাদের দেশে আসলে সুরে বাজানোর মতো মিউজিশিয়ান খুব বেশি নেই, হাতেগোনা কয়েকজন। তাদের পাওয়াটাও কঠিন। এই কারণে অনেকে কি বোর্ড দিয়েই গান করেন।</p> <p><strong>বাধার মুখে নারায়ণগঞ্জে লালনমেলা স্থগিত হলো। শুনেছেন নিশ্চয়ই?</strong></p> <p>এখানে আমি কোনো পক্ষ নিয়ে বলব না। আগে দেখতে হবে মেলার উদ্দেশ্য কী ছিল। লালনমেলার নামে অশালীন কিছু হওয়ার ইঙ্গিত ছিল কি না! অনেক শিল্পী এখন লালনগীতি করেন অশালীনভাবে। তা ছাড়া দর্শক নাচানোর একটা আলাদা কালচার তৈরি হয়েছে। আমি ফরিদা পারভীন কখনো তো স্টেজে নেচে নেচে গান করিনি, আমার শ্রোতারা কি গান শোনেনি? তারা কি শো ছেড়ে উঠে গেছে! যারা সংগীতকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারে না তারাই স্টেজে উঠে লাফালাফি করে। যা বললাম, আমার জ্ঞান থেকে বললাম। কেন নারায়ণগঞ্জের লালনমেলা স্থগিত হলো সেটা সরকারই ভালো বলতে পারবে।</p> <p><strong>৬৫ বছর ধরে গাইছেন। অর্জনও অনেক। তবু কি কোনো অপূর্ণতা অনুভব করেন?</strong></p> <p>কিছু অপূর্ণতা তো রয়েছেই। মনে হয়, যদি আরো গাইতে পারতাম, আরো শিখতে পারতাম! তাহলে সংগীতের মহাসমুদ্রে কিছুটা জায়গা করে নিতে পারতাম। দিন শেষে আমি একজন মা। আমার পরিবার আছে, সন্তান আছে। তাদের খেয়াল করতে গিয়ে হয়তো সংগীতে নিজেকে ততটা উজাড় করে দিতে পারিনি। তবে এই অপূর্ণতা আমাকে খুব একটা কষ্ট দেয় না। কারণ আমার কিছু প্রাপ্তিও আছে। একবার দিল্লিতে গিয়ে হিন্দিতে লালনগীতি গেয়েছিলাম। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ছিলেন শ্রোতার সারিতে। গান শেষে আমাকে ডেকে বললেন, ‘মা, তুমি তো বাঙালি। হিন্দিতে এত সুন্দর উচ্চারণ করে লালনগীতি গাইলে কিভাবে! আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। তোমার জন্য অনেক আশীর্বাদ।’ আরেকবার ফ্রান্সে অপেরা সংগীতের সঙ্গে লালনগীতি গেয়েছি, সেটার লাইভ রেকর্ড বাজারে আসার পর দারুণ সাড়া পড়েছিল। জাপানের লাইভ রেকর্ডটাও বাজারে আছে। আমিও মাঝেমধ্যে এগুলো শুনি। তখন মনে হয়, আমি তো সত্যিই ফরিদা পারভীন হতে পেরেছি! এক জীবনে এমন প্রাপ্তি কজনে পায়!</p>