<p>দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। গতকাল বিকেলে তার মা নন্দিতা সেনগুপ্ত মারা গেছেন। দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল আনুমানিক ৭৬।</p> <p>মাকে নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার অনলাইনে শোকগ্রস্ত ঋতুপর্ণা একটি স্মৃতিচারণামূলক লেখা লিখেছেন। কালের কন্ঠের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল— </p> <p>‌‘‘মা সেই চলেই গেল। আটকাতে পারলাম না। সব কেমন ওলটপালট। অভিনেত্রী ঋতুপর্ণার কথা তো সকলেই জানে। নন্দিতা সেনগুপ্তের মেয়েকে কত জনই-বা জানত! আমার জীবনে এগিয়ে যাওয়া, সফলভাবে কাজ করা, ভেঙে পড়া, উঠে দাঁড়ানো—সব মায়ের কঠোর সমর্থনে। শুধুই মা। মা আমার দুর্গা। আমার মনের জোর। জন্ম থেকে আমার মধ্যে যে আত্মবিশ্বাসের বীজ মা বুনে দিয়েছিল তার জেরেই আমি ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। সব কিছুতে এগিয়ে যেতে হবে আমাকে, মা স্পষ্ট করে দিয়েছিল। মেয়ে বলে আলাদা করে মানুষ করা, এমন কখনও দেখিনি মায়ের মধ্যে।</p> <p>মা আচমকাই অক্টোবরের শেষের দিকে হাসপাতালে ভর্তি হলো। আগেও হয়েছে। কিন্তু ফিরে এসেছে। সেই কারণেই ভাবলাম যার এত মনের জোর সে ঠিক ফিরবেই। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হতে শুরু করল। একদিন মনে হলো, কার কাছে যাব? মা বাড়িতে নেই। মা কথাও বলছে না। কাছে যাচ্ছি, কিন্তু গেলেও তো জড়িয়ে ধরে সব কথা, সমস্যার কথা বলতে পারছি না। কী করি? হাসপাতালে মাকে দেখে রবিনসন স্ট্রিটে মায়ের বাড়ি চলে গেলাম। অস্থির মন। মাকে তন্নতন্ন করে খুঁজছি। মন ডুকরে উঠছে। কোথায় মা? কী মনে হলো, মায়ের শাড়ির আলমারি খুললাম। ওখান থেকে আর সরতে পারি না। কত শাড়ি। আমার কত স্মৃতি জড়িয়ে ওই আলমারিতে। আর তখনই মায়ের গন্ধটা পেলাম। মাকে না পেয়ে ওই শাড়িগুলোই ঘাঁটছিলাম আমি। মনটা সেদিন স্থির হলো। যেন মাকেই খুঁজে পেলাম।</p> <p>তখনও ভাবিনি মাকে হাসপাতালেই শেষ দেখব। বিগত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালের ঘেরাটোপে আমার সবাক, সজীব মাকে শুধু কষ্ট পেতেই দেখলাম। আমি কাজের জন্য যেমন নিয়মিত বাইরে যাই, এবার আর যাইনি। দু’দিন জরুরি কাজ ছিল তাই যেতেই হলো। বাকি দিনগুলো শহর ছাড়িনি। মনে হত মায়ের কাছেই আছি।</p> <p>ছোটখাটো প্রতিটা সুখ-দুঃখের অনুভূতি মনে পড়ে যাচ্ছিল। স্কুলজীবনে ভোর চারটে নাগাদ আমাকে ঘুম থেকে তুলে দিত মা। আমাকে পড়াত। এত সুন্দর বাংলা লিখতে পারত। মায়ের থেকেই সব শিখেছি আমি। এই কিছুদিন আগেও রবি ঠাকুর বা নজরুল মা অনায়াসে আবৃত্তি করতে পারত। সারাটা জীবন দেখে এলাম মায়ের ঘরে রাত তিনটা পর্যন্ত আলো জ্বলছে। মা যেখানেই থাকুক রাতে আগে বই পড়ে, তারপরে ঘুম। রবীন্দ্রসংগীত ভালবাসত। অন্য গানও। আমার ছোটবেলা মায়ের সঙ্গে খুব আনন্দে কেটেছে, নিশ্চিত আশ্রয়ের কোল, আমার মায়ের কোল। ছোট বয়স থেকেই মা শিখিয়েছিল যার যা নেই, আমার থাকলে তাকে সেটা দিতে হয়। তখন থেকেই সামাজিক সচেতনতার বোধ তৈরি হয়েছিল আমার মধ্যে। তাই কিছু যদি দিতে পারি কাউকে আমার খুব আনন্দ হয়। মা বুঝিয়ে দিয়েছিল দায়িত্ববোধ কী। এগুলো নিয়ে চলতে চলতেই জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।</p> <p>বকাও খেতাম খুব মায়ের কাছে। বড় হয়েও সেসব চলত পুরো মাত্রায়। খাবার নষ্ট করলে খুব রেগে যেত মা। আমার ছেলেমেয়েদেরও একই শিক্ষা দিয়েছে আমার মা। সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। কোনো কথা বলতেই ভালো লাগছে না। এখন মায়ের কোলে মাথা রেখে একলা বড় একটা আকাশের তলায় যদি চলে যেতে পারতাম! কার কাছে পরামর্শ নিতে যাব আমি? কে বলবে, ‘তুই কাজ করে যা, সব ঠিক হয়ে যাবে, ভেঙে পড়বি না!’ কার সঙ্গে মন খুলে ঝগড়া করব?’’</p>