<p>সারা শরীরে ছররা গুলি। রক্তাক্ত দেহ। কিছুদূর এগোতেই ঢলে পড়েন আল-আমীন নামের এক যুবক। তার মতো এমন আরো সাতজন সড়কের মাঝেই পড়ে থাকে। নিঃশ্বাস আছে কি না, পরখ করে দেখে পুলিশ। বেঁচে আছে বুঝতেই ফের গুলি।</p> <p>আল-আমীন জানান, তার নাকের সামনেও পরখ করা হয়, তার শ্বাস আছে কি না। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে শ্বাস বন্ধ করে দেন তিনি। তিনিসহ চারজন এভাবে বেঁচে যান। তখন রাত। খুব একটা লোকজনও ছিল না। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লোকজনকে ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক সময় পর একজন ছাত্রসহ কয়েকজন ডাকে সাড়া দেন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করান তারা। পরিবারে খবর দেওয়া হয়। খবর পেয়ে প্রথমে এক ভাই ছুটে আসেন।</p> <p>ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার রাইতলা গ্রামের একিন আলীর ছেলে মো. আল-আমীন। সোমবার সকাল ১১টার দিকে কসবা উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে কথা হয় আল-আমীনের সঙ্গে। মিনিট পাঁচেক কথা বলার পর তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না।</p> <p>বসার পরও আল-আমীন কেমন যেন অস্থিরতায় ভুগছিলেন। মাথার চুল টেনে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন। কাছে গিয়ে বুঝা গেল, সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে কিছু বলছেন। উফ, এত রক্ত, কথাটা কানে বাজে।</p> <p>আল-আমীন জানান, সংসারে স্ত্রী ছাড়াও তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ঢাকায় অন্যের সেলুনের কাজ করেন তিনি। পেট, কোমর, ঊরুতে গুলির যন্ত্রণা এখনো সইতে হচ্ছে। একাধিক অপারেশনের পর এখনো স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেননি আল-আমীন। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে কাজও করতে পারেন না।</p> <p>নিজের চিকিৎসা ও পরিবার নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় থাকা আল-আমীন বলেন, ‘কী করব, জানি না। এখানে-সেখানে ঘুরছি। কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছি না। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে একবার সহায়তা করা হয়। সরকারি কিছু সহায়তা পেলে আমার জন্য ভালো হতো।’</p> <p>ঘটনা ১৮ জুলাই রাতে। ঢাকার রায়েরবাগ এলাকায় আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন আল-আমীন। সন্ধ্যার দিকে পুলিশের ছুড়া কাঁদানে গ্যাসে মুখসহ সারা শরীর জ্বালাপোড়া করতে থাকে। একটি বাড়ি থেকে দেওয়া টুথপেস্ট মুখে মেখে যন্ত্রণা কিছুটা কমান। বাড়িগুলো থেকে তাদেরকে খাবারও সরবরাহ করা হচ্ছিল।</p> <p>রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে পুলিশের ছররা গুলিতে তিনি আহত হন। দুই ধাপে তার শরীরে অনেক গুলি লাগে। চিকিৎসা করালেও ডান কাত হয়ে ঘুমাতে পারেন না। বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না এখনো।</p> <p>আল-আমীন বলেন, ‘মন চাইলেও নিজের সন্তানদের মুখে দিকে তাকিয়ে আন্দোলনে যেতাম না। মনে হতো আমার কিছু হলে তাদের কে দেখবে। ১৩-১৪ জুলাইয়ের দিকে এক শিশু আমার দোকানের সামনে বিপদে পড়ে। পুলিশ তখন এলোপাতাড়ি গুলি করছিল। শিশুটিকে দোকানে এনে রক্ষা করি। শিশুটির বাবা এসে শিশুটিকে নিয়ে যান। দোকান থেকে বের হতেই বাবার কোলে থাকা অবস্থায়ই শিশুটির ওপর গুলি লাগলে সে মারা যায়। এরপর আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারিনি। ভাবতে থাকি, এভাবে নির্বিচারে হত্যা তো মেনে নেওয়া যায় না। আজ অন্যের সন্তান তো কাল আমার সন্তানকে মেরে ফেলবে। এর পর থেকে নিয়মিত আন্দোলনে যোগ দিই।’</p> <p>আহত হওয়ার পরও লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয় বলে জানান আল-আমীন। বিষণ্ন মন নিয়ে তিনি বলেন, ‘একে তো পুলিশের নির্মমতার শিকার হয়েছি, তার ওপর ঢাকা মেডিক্যালেও কম লাঞ্ছিত হইনি। প্রথম প্রথম তো আমাদের চিকিৎসাই দিতে চাইত না। ওষুধ কিনে আনতে হতো বাইরে থেকে। জমানো টাকা শেষ হওয়ার পর আত্মীয়দের কাছে হাত পাতি। ওই টাকাও শেষ হয়ে যায়। স্বজনদের কেউ কেউ বলেন, আমি কেন আন্দোলনে গেলাম। ৫ আগস্ট যখন আন্দোলন সফল হয় তখন থেকে সব কিছু যেন নতুনমাত্রা পায়। আমাকে ভালোভাবে চিকিৎসাও দেওয়া শুরু হয়।’</p> <p>পেটে সেলাইয়ের দাগ, কোমরের ওপরের অংশ ও ঊরু থেঁতলে থাকা দেখিয়ে আল-আমীন জানান, সরকার কিছু একটা করবে বলে তিনি আশায় আছেন। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে গায়ে প্রায় চার মাস পর ঠিকভাবে কাপড় পরেছেন।</p>