<p>২০১৪ সালে নাটোর-২ (সদর) আসন থেকে প্রথমবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শফিকুল ইসলাম শিমুল। এর পর থেকে নাটোর শহর ও আশপাশের এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন শিমুল ও তাঁর বাহিনী। এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে শিমুল গড়ে তোলেন অস্ত্রধারী এই বাহিনী। এই বাহিনী চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে বিএনপি-জামায়াতসহ প্রতিপক্ষের ওপর চালাত দমন-নিপীড়ন।</p> <p>নিজ দলের নেতাকর্মীরাও শিমুল বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। সরকারি অফিস-আদালত থেকে শুরু করে, পরিবহন মালিক সমিতি, ট্রাক ও ট্র্যাংক-লরি পরিবহন সমিতি দখল, জমি দখল, প্রাণ কম্পানি দখল, রাস্তায় চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, সরকারি প্রকল্পের কমিশন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন শিমুল।</p> <p>স্থানীয়রা জানায়, বস্তুত শিমুল নাটোর শহরকে তাঁর ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। এর মাধ্যমে শিমুল কানাডার টরন্টোতে বাড়ি, নাটোর সদরে আলিশান বাড়িসহ গত ১০ বছরে অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। শিমুলের সম্পদ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দম কমিশন (দুদক) টিম।</p> <p>সূত্র মতে, ২০১৪ সালে শিমুল এমপি হওয়ার পর প্রথমে হামলা করেন সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলীর বাসায়। একই বছর তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। নাটোর সদরে বিএনপি-জামায়াত কোনো কর্মসূচি দিলে শিমুল বাহিনী অস্ত্র নিয়ে হামলা চালাত নেতাকর্মীদের ওপর। সাবেক মন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বাড়িতে দফায় দফায় হামলা, ভাঙচুর, বিএনপি নেতাকর্মীদের মারধর ছিল শিমুল বাহিনীর নিত্যদিনের কাজ।</p> <p>বিএনপি নেতা ফরহাদ আলী দেওয়ান শাহিন বলেন, ‘শিমুল এমপি হয়ে নাটোরের কোনো উন্নয়ন না করে নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন করেছেন। সন্ত্রাসের মাধ্যমে সব কিছু দখল করেন, চাঁদাবাজি করে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাঁর বাহিনীর হামলায় গত ১০ বছরে নাটোর সদরে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অন্তত শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশত নেতাকর্মী।</p> <p>শিমুল নাটোর সদরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তাঁর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। এমনকি তাঁদের দলীয় নেতাকর্মীরাও তাঁর অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রক্ষা পাননি।’</p> <p>জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, ‘এই বৃদ্ধ বয়সে আমার ওপর হামলা চালিয়েছে শিমুল বাহিনী। নির্যাতনের শিকার হয়ে আমি প্রায় পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন যাপন করছি। শিমুলের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে কেউ রেহাই পাইনি।’</p> <p>আব্দুর রহিম নামের বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘রাস্তায় বাস-ট্রাক থেকে চাঁদা আদায়সহ নাটোরের প্রাণ কম্পানির উচ্ছিষ্ট মালপত্র, খৈল থেকে শুরু করে নানা মালপত্র ছিল শিমুল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। প্রাণের খৈল শিমুল তার নিজের ইচ্ছায় বিক্রি করত। তার হুকুম ছাড়া বাইরের কেউ প্রাণের খৈল কিনতে পারত না।’</p> <p>নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরাও তো শিমুলের অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছি। গত ১০ বছরে শিমুল এবং তার লোকজন নাটোরে যা বলেছে, তাই হয়েছে। আমরা কিছুই করতে পারিনি। তার পরও এখন আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। নাটোরে লুটপাট করেছে শিমুল ও তার বাহিনীর লোকজন। এখন খেসারত দিতে হচ্ছে বঞ্চিতদের।’</p> <p>এদিকে শিমুলের নামে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থপাচার করে কানাডায় বাড়ি কেনার অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে দুদক সূত্র। এ ছাড়া গত ১৫ আগস্ট শফিকুল ইসলাম শিমুল এবং তাঁর স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। স্ত্রীর নামে নাটোর সদরে জান্নাতি প্যালেস গড়ে তোলেন শিমুল; যে বাড়ির নির্মাণসামগ্রী তিনি বিদেশ থেকে এনেছেন। গত ৫ আগস্ট শিমুলের ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরে ওই বাড়ি থেকে চারজনের পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়।</p> <p>সূত্র মতে, শিমুল সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ২০১৮ সালে দ্বিতীয় বার এমপি হয়ে। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার ও কানাডায় বাড়ি কেনার অভিযোগ ওঠে। গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত শিমুল ও তাঁর বাহিনী নাটোর শহরজুড়ে চালিয়েছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। নাটোরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে শিমুল বাহিনী বাস ও ট্রাক থেকে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করত। প্রতিটি ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করা হতো ২০০ টাকা। এর বেশির ভাগ যেত শিমুলের পকেটে।</p> <p>এর বাইরে জমি দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন প্রকল্পের কমিশন আদায়সহ নানা অপকর্ম করে শিমুল অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠেন। অথচ একসময় তাঁর তেমন কিছুই ছিল না। বর্তমানে নাটোর ও ঢাকায় রয়েছে তাঁর বাড়ি, নামে-বেনামে জমি, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে জমানো অর্থ, সঞ্চয়পত্র, বিদেশের বাড়িসহ শিমুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে দাবি স্থানীয়দের।</p> <p>এসব বিষয়ে জানতে বিভিন্ন মাধ্যমে শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।</p>