<p>সারার বয়স ১৫ বছর। ক্লাস এইটে পড়ে। মায়ের অভিযোগ হচ্ছে, শুরু থেকেই ওর পিরিয়ড নিয়মিত হয় না। দুই-তিন মাস পর পর  হয় এবং শুরু হলে আর সহজে ভালো হতে চায় না, ব্লিডিং অনেক বেশি হয়। ইদানীং ওর  মুখে কিছু অবাঞ্ছিত লোম দেখা দিচ্ছে। মুটিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। নাবিলার বয়স ২৯ বছর। বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। এখনো বাচ্চা হচ্ছে না। মাসিকও অনিয়মিত। ইদানীং ডায়বেটিস ও থাইরয়েড হরমোনের সমস্যাও ধরা পড়েছে।</p> <p>বিশ্বজুড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ নারী পিসিওএস বা পলিসিসটিক ওভারিয়ান সিনড্রোম রোগে ভুগছে। সারা বিশ্বে বন্ধ্যাত্বের জন্য এই রোগকেই সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়।</p> <p> </p> <p><strong>কারণ</strong></p> <p>পিসিওএস  বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম-এর প্রকৃত কারণ অজানা। তবে  হরমোনজনিত,  মেটাবলিক, জেনেটিক ও পরিবেশগত কিছু  কারণকে এ রোগের জন্য দায়ী করা হয় । এই রোগে মেয়েদের শরীরে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন বা পুরুষ হরমোনের আধিক্য দেখা যায়। যার ফলে মেয়েদের শরীরে প্রতি মাসের স্বাভাবিক ডিম বড় হওয়া এবং ডিম ফোঁটা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে অতিরিক্ত ডিম্বানু ডিম্বাশয় বা ওভারিতে জমা থাকে। ওভারি স্বাভাবিকের চেয়ে আকার অনেক বড় হয়। জমে থাকা ডিম্বানুগুলো ছোট ছোট পানির ব্যাগ বা সিস্টের মতো আলট্রাসনোগ্রাফিতে দেখা যায়। সত্যিকার অর্থে কোনো সিস্ট ডিম্বাশয় থাকে না। নিয়মিত ডিম না ফোটার ফলে ঋতুচক্র বাধাগ্রস্ত হয়। একই কারণে মেয়েদের বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়।</p> <p>অতিরিক্ত মেদবহুল শরীর বা ওবেসিটি এ রোগের  সিভিয়ারিটি বাড়িয়ে তোলে। এই রোগীদের শরীরের ইস্ট্রোজেন বা নারী হরমোনগুলো ফ্যাট বা চর্বির মধ্যে গিয়ে অ্যান্ড্রোজেন বা পুরুষ হরমোনে</p> <p>রূপান্তরিত হয়ে শরীরে অ্যান্ড্রোজেনের আধিক্য বাড়ায়।</p> <p>ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এ রোগের অন্যতম কারণ, এবং  অন্যতম লক্ষণ। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হলো ইনসুলিন হরমোনের কাজ করার অক্ষমতা, যা বিভিন্ন হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, অ্যান্ড্রোজেনের আধিক্য বাড়ায়, ডায়াবেটিস রোগের উৎপত্তি ঘটায়, গ্লুকোজের মেটাবলিজম নষ্ট  করে। ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজন, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সকে ত্বরান্বিত করে। তবে স্বাভাবিক ওজনের মেয়েদেরও পিসিওএস থাকতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগের লক্ষণগুলো বাড়তে থাকে।</p> <p>এ রোগটি বংশগত বলা হয়ে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় মা, বোন বা খালার মধ্যে এই রোগটি থাকলে পরবর্তী প্রজন্মেরও একইভাবে রোগটি দেখা দেয়।</p> <p>পরিবেশগত বিভিন্ন বিষয়, যেমন—খাদ্যাভ্যাস, লাইফস্টাইল ইত্যাদি এ রোগের উৎপত্তি ও  সিভিয়ারিটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত।</p> <p> </p> <p><strong>উপসর্গ</strong></p> <p>পিসিওএসের উপসর্গ শুরু হয় সাধারণত নারীদের মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকেই। তবে উপসর্গের ধরন এবং তীব্রতা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে।</p> <p>যে উপসর্গ সবার মধ্যে দেখা যায়, তা হলো অনিয়মিত মাসিক। এ ছাড়া  অন্য লক্ষণগুলো হলো—</p> <p> মুখে, বুকে, পেটে অবাঞ্ছিত লোম।</p> <p>►       ব্রণ, তৈলাক্ত ত্বক বা খুশকি।</p> <p>►       অতিরিক্ত চুল পড়া বা পুরুষের মতো টেকো ভাব।</p> <p>►       ঘাড়, হাত, স্তন বা উরুতে চামড়ায় গাঢ় বাদামি বা কালো দাগ। এটা বগলে বা পায়ের ভাঁজেও হতে পারে।</p> <p>►       মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা বেড়ে যাওয়া।</p> <p>►       বন্ধ্যাত্ব।</p> <p>►       কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া।</p> <p>►       ডায়াবেটিস।</p> <p>তবে এসব উপসর্গের অনেকটিই অনেকের না-ও থাকতে পারে।</p> <p> </p> <p><strong>দীর্ঘমেয়াদি লক্ষণ</strong></p> <p>উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক,  এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার বা জরায়ু ক্যান্সার ইত্যাদি।</p> <p>পলিসিসটিক ওভারিয়ান সিনড্রোম ও বন্ধ্যাত্ব</p> <p>বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্ধ্যাত্বের কারণ খুঁজতে গিয়ে এই রোগটি প্রথম ধরা পড়ে। তবে কারো পিসিওএস থাকা মানে এই নয় যে তিনি কখনোই মা হতে পারবেন না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও জীবনযাপনে পরিবর্তনের মাধ্যমে তাঁরাও মা হতে পারবেন। এ সমস্যাটি ধরা পড়লে আশাহত হওয়া যাবে না। ধৈর্যসহকারে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে।</p> <p> </p> <p><strong>প্রতিরোধ ও চিকিৎসা</strong></p> <p>যেহেতু একাধিক কারণে পিসিওএস জটিলতা তৈরি হয়, তাই একক কোনো চিকিৎসা নেই এটি ভালো করার। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জটিলতা নিরসন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।</p> <p>রোগের লক্ষণ, তীব্রতা অনুযায়ী চিকিৎসা নির্ভর করে।</p> <p>►   অতিরিক্ত ওজন, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি পিসিওএসের লক্ষণগুলো বৃদ্ধি করে, তাই লাইফস্টাইল মডিফিকেশন বা জীবনধারায় পরিবর্তন পিসিওএস চিকিৎসার অন্যতম স্লোগান। গবেষণায় দেখা যায়, মাত্র ১০ শতাংশ ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ডিম ফোটা শুরু হয় এবং মাসিক নিয়মিত হতে শুরু করে।  নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, সঠিক সময়ে ঘুম, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন ইত্যাদি এটির অন্তর্ভুক্ত।</p> <p>ব্যায়াম নিয়মিত : সঠিক ওজনের মাত্রা ঠিক করতে বিএমআই চার্ট ফলো করেন চিকিৎসকরা। অর্থাৎ হাইট অনুযায়ী ওজন কত থাকা দরকার তা ঠিক করে দেন। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ৪০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা মধ্যম মাত্রার ব্যায়াম নিয়মিত করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে হাঁটা, জগিং ইত্যাদি। যোগ ব্যায়ামও অনেকটা কার্যকরী।</p> <p>কিশোরীদের জন্য পূর্ণমাত্রার ব্যায়াম নিয়মিত এক ঘণ্টা করে করা দরকার। এর মধ্যে রয়েছে খেলাধুলা, সাইক্লিং, সাঁতার কাটা ইত্যাদি। বর্তমানে কিশোরীদের পড়াশোনা এবং সামাজিক অবস্থাগত কারণে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি নাই বললেই চলে। এ কারণে এই বয়সী রোগীর সংখ্যা ইদানীং বেড়েই চলেছে।</p> <p>সুষম খাবার : সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে। জাংক ফুড, অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করা জরুরি। </p> <p>যথাযথ ঘুম : সঠিক সময়ে ঘুম পিসিওএস প্রতিরোধে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, পিসিওএস রোগীদের ‘মেলাটোনিন’ হরমোন নিঃসরণে ভারসাম্যহীনতা থাকে। মেলাটোনিন মস্তিষ্কের হরমোন নিঃসরণের সেন্টারগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত রাত ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত ঘুমন্ত অবস্থায় এ হরমোন  নিঃসরণ হয়। এ সময় জেগে থাকলে রক্তে মেলাটোনিনের মাত্রা কমে যায় এবং পিসিওএসের  লক্ষণগুলো বেড়ে যায়।</p> <p>►   চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হরমোন জাতীয় ওষুধ নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাসিক নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রোজেস্টেরন হরমোন, ওরাল পিল, মেটফরমিন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।</p> <p>►   ওভুলেশন ইনডাকশন উপায়ে ডিম বড় করা ও ফোটানোর ব্যবস্থা করার জন্য মেডিসিন ব্যবহার করা হয়। বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এ চিকিৎসা নিতে হবে।</p> <p>►   অবাঞ্ছিত ও অতিরিক্ত লোমের জন্য উপরোক্ত চিকিৎসার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ক্রিম, ওয়াক্সিং, লেজার ট্রিটমেন্ট ইত্যাদি করা যেতে পারে।</p> <p>►   যাদের জরায়ুর ক্যান্সার ঝুঁকি রয়েছে, তা কমানোর জন্য ডাক্তারের নির্দেশিত ওষুধ সেবন করতে হবে। নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হবে।</p> <p>পিসিওএস মূলত একটি বহুমাত্রিক ও ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি রোগ। সম্পূর্ণ নিরাময়ের কোনো চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে লাইফস্টাইল মডিফিকেশন জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন ও লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করলে সুস্থ থাকা সম্ভব। আর তাই সচেতনতার বিকল্প নেই।</p> <p> </p> <p>লেখক : প্রসূতি, স্ত্রীরোগ, প্রজনন হরমোন ও বন্ধ্যাত্ব রোগ বিশেষজ্ঞ এবং ল্যাপারোস্কোপিক সার্জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা</p>