<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ছিটমহল আমাদের ভূখণ্ডে এখন ইতিহাস ও জাদুঘরের চর্চার বিষয়। অথচ একদিন এটি ছিল নিত্য যন্ত্রণার ও হাহাকারের নাম। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিটমহল বিনিময় কার্যকরের পর আজ ৯ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। কোনো একটি জাতির জীবনে ৯ বছর হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু একজন মানুষের জীবনে সেটি অনেক বড়। আবার সেটি যখন বন্দিজীবন হয় তা আরো দীর্ঘ ও নরকসম। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ছিটমহল ছিল আমাদের ও ভারতীয় রাষ্ট্রীয় জীবনে নরকসম। ছিটমহলের নাগরিকরা বন্দি ছিলেন ৬৮ বছর ধরে। এই ৬৮ বছরে ছিটমহলের নাগরিকরা কারাবন্দির মতো জীবনযাপন করেছেন। ভুক্তভোগীরা জানেন ছিটমহলের মানুষের কান্না কত যন্ত্রণাকর ছিল। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হলে তদানীন্তন ছিটমহলবাসী স্বাধীন ভারত বা পাকিস্তানের কোনো পক্ষের প্রাপ্য স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেননি। দাবা বা পাশা খেলার পণ হিসেবে রাজরাজড়ারা জুয়ায় জিতে এগুলোর মালিক ছিলেন। কোচবিহারের মহারাজা ১৭৭২ সাল থেকে ব্রিটিশকে কর দিয়ে নিজেই কোচবিহার রাজ্যের মালিক ছিলেন। রাজার অধীস্থ সব জমির মালিক বিধিগতভাবে তাঁর হওয়ায় এর মালিক ছিলেন মহারাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণ। দেশভাগের পর তাঁর মালিকানাধীন ১১১টি ছিটমহল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অংশে পড়ে যায়। ১৯৪৯ সালের ২৮ আগস্ট কোচবিহার মাজার অ্যাগ্রিমেন্টবলে কোচবিহার রাজ্য ভারতে বিলুপ্ত বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ছিটমহলগুলো ভারতের মালিকানায় চলে যায়। যেগুলোর অবস্থান আবার রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড় জেলায়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আবার পূর্ব পাকিস্তানের মালিকানাধীন ৫৩টি ছিটমহল ভারতের অন্তর্গত থেকে যায়। এর মধ্যে আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম তিনবিঘায় একটি করিডর পেলে তাঁদের কিছুটা কষ্ট লাঘব হলেও অন্যদের কষ্ট থেকে যায়। ছিটমহলের কষ্ট লাঘবের জন্য স্থানীয়দের থেকে চাপ থাকলেও রাষ্ট্র খুব একটা পাত্তা দেয়নি। এর পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের আগে পাকিস্তান ও ভারত একবার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল, যেখানে ছিটমহলের সমাধানের নিমিত্ত একটি চুক্তিও হয়েছিল, যা নেহরু-নুন চুক্তি নামে পরিচিত। কিন্তু সে চুক্তিও বাস্তবায়ন হয়নি বা আলোর মুখ দেখেনি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="শোকের মাসে মানবতার মুক্তি" height="210" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/07.July/01-08-2024/6678.jpg" style="float:left" width="320" />বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আবারও বিষয়টি সামনে চলে আসে। ছিটমহলের মানুষের বেদনার কথা বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি তাঁর স্বল্প শাসনামলেই ১৯৭৪ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ল্যান্ড বাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট নামে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন, যা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামেও সমধিক খ্যাত। যে চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময় প্রধান ছিল। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আন্তর্জাতিক যেকোনো চুক্তির কার্যকারিতার জন্য নিজ নিজ দেশের সংসদে সংশ্লিষ্ট চুক্তির অনুমোদন দরকার হয়। সেই মতে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সার্বিক তত্ত্বাবধানে সেটি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অনুমোদিত (রেটিফাই) হলেও ভারতীয় সংসদে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বলি হলে বিষয়টি আবারও ঝুলে যায়। বিশেষত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা রাজনীতির প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে দাঁঁড়িয়ে যায়। পাকিস্তানি ভাবধারা বৃদ্ধি পায়। ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। যে কারণে ভারতও কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করে বলে অনেকেই মনে করেন।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই খেলায় পড়ে আবারও উভয় দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষের বন্দিত্বের মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া বিষয়টি মাঝেমধ্যে তুললেও সেটির জন্য কার্যকর লাগাতার উদ্যোগ অনুপস্থিত ছিল। কারণ তাঁদের রাজনীতিই ছিল ভারত বিরোধিতাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় টিকে থাকা। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে গোলামির চুক্তি, দেশ বিক্রির চুক্তিরূপে উপস্থাপনের নোংরা প্রচেষ্টা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও এ চুক্তি ঘিরে ভারত বিরোধিতার নামে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাঠে নামে। এই চুক্তিকে ধরে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনীতির মাঠে নিজেদের আর্টিকুলেটেড করার প্রয়াস পায়। দিন চিরদিন সমান যায় না সবার, ষড়যন্ত্রকারীরা সবক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বঙ্গবন্ধুকন্যা এই চুক্তির বলেই ৯ বছর আগে জোর প্রচেষ্টা নিয়ে বিষয়টির সুরাহা করেন। তিনি সফল হন ঝুলে থাকা ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তিটি ভারতীয় সংসদে রেটিফাই করাতে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার শেষ মেয়াদে চেষ্টা করলেও সেটি ভারতীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে সফল হতে পারেনি। শেষবারে তিনি সফল হন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কুশলী ভূমিকায় তরুণ গগৈ বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আঞ্চলিক সরকারগুলোকেও তিনি সম্মত করাতে পেরেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭১ যেমন সর্বসম্মতভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি গৃহীত হয়েছিল, তেমনিভাবে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ল্যান্ড বাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট সর্বসম্মতরূপে ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় গ্রহণ হয়েছিল। এই চুক্তিটি এমন একটি চুক্তি, যা দুই দেশের মানচিত্রের বদল করেছে। এই চুক্তিটি হওয়ার পর কে বেশি লাভবান হবে এটি আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বহুদিন। জমির হিসাবে হয়তো বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ১৭ হাজার একর জমি লাভ করে। আবার মানুষের হিসাবে বাংলাদেশ প্রায় ৪০ হাজার ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে ভারত সাত হাজার একর জমি আর ১৪ হাজার ২১৫ বাংলাদেশের নাগরিককে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়। লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় যে যে যুক্তিই দেখাক ওই চুক্তির ফলে মানবতার বিজয় হয়েছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ছিটমহলের বাসিন্দারা উভয় দেশেই নাগরিক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে যুক্ত হওয়া ছিটমহলগুলোর জমির রেকর্ড সম্পন্ন হয়েছে। ফাইনাল পর্চা প্রদান হয়েছে। রেকর্ড একেবারেই ত্রুটিমুক্ত হয়েছে সেটি বলা যাবে না, তবে অন্যান্য রেকর্ডের চেয়ে ছিটমহলের জমির রেকর্ডে ভুলভ্রান্তি নিতান্তই কম হয়েছে। তার পরও সেগুলো সংশোধনের জন্য আদালতের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেটিও হয়তো নিকট ভবিষ্যতে হবে। এর ফলে ছিটমহলের মানুষ জমির মালিকানা পেয়েছেন, নাগরিক পরিচয়সহ রাষ্ট্রের মূল স্রোতধারায় সংযুক্ত হয়েছেন। শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার পেয়েছেন। আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার পেয়েছেন। পছন্দমতো রাজনৈতিক দল ও পদ-পদবিতে নিজেদের যুক্ত করছেন। ছিটমহলগুলোতে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন নানা ইমারত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছিটমহলগুলোকে আজ উন্নয়নের অবয়বে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পৃথকভাবে চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সাবেক ছিটমহলগুলোর বর্তমান অবস্থানকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে গেলে বোঝা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ১১১টি ছিটমহলে প্রধানমন্ত্রীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে যে পরিমাণ উন্নতি হয়েছে, তা প্রমাণ করে চুক্তির মর্মবস্তুর সার্থক রূপায়ণ হয়েছে। প্রকৃতই জয় হয়েছে মানবতার। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তবে একটি বিষয় বাংলাদেশে যুক্ত হওয়া ছিটমহলগুলোয় ঝুলে রয়েছে, তা হলো যেসব ব্যক্তি পছন্দক্রমে ভারতীয় অংশে যুক্ত হয়েছেন তাঁরা ভারতে যাওয়ার সময় তাঁদের মালিকানাধীন জমিজিরাত এখানেই রেখে যান। এই জমিগুলোর দায়িত্ব পান সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসকরা। কথা ছিল ওই জমিগুলো তাঁদেরই থাকবে। ন্যায্য মূল্য বা প্রকৃত মূল্যে সেগুলো বিক্রি করতে চাইলে তা তাঁরা করতে পারবেন। এই মুহূর্তে তাঁদের কেউ পূর্বতন ছিটমহলে রেখে আসা জমি বিক্রি করতে চাইলেই বিক্রি করতে পারছেন না। উপরন্তু বর্তমানে সে জমিগুলো আবার সরকারের নামে ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত হয়েছে। এখন ইচ্ছা করলেই সেগুলো বর্তমানে পূর্বতন মালিকরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে পারছেন না। বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আর একটি সমস্যা বাংলাদেশ থেকে যাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব অব্যাহত রেখে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য ভারতে গিয়েছেন তাঁদের অনেকেই আবার বাংলাদেশ অংশে যুক্ত হওয়া ছিটমহলে পুনরায় ফিরতে চান; অর্থাৎ নিজেদের পুরনো বাড়িভিটায় ফিরতে চান। তাঁরা অনেকেই আবেগ আর বিভ্রান্তির শিকার হয়ে সুখ-স্বপ্নে ভারতে গেছেন। সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে তাঁদের অনেকেই ফিরতে চান, তাঁদের বিষয়েও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রদ্বয়ের বিবেচনা থাকা উচিত। কারণ ছিটমহলের মানুষের মুক্তিই ছিল ছিটমহল বিনিময় চুক্তির মূলকথা।   </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">১ আগস্ট ছিলমহলে মুক্তির দিন। আগস্ট আমাদের জীবনে শোকের মাস। এ মাসেই বঙ্গবন্ধু শাহাদাত বরণ করেছেন। যে চুক্তি ঘিরে ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে হত্যা করেছেন, সে মাসের সূচনা দিনেই ছিটমহলে মানবিক মুক্তি গড়েছেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। অশ্রুপাতের মাসের সূচনায় ছিটমহলের মুক্তির কারিগর বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর সূচিত পথেই ছিটমহলে মানুষের মুক্তি হয়েছে। </span></span></span></span></p> <p> </p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> লেখক : একুশে ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত ব্যক্তি ও অধুনালুপ্ত ছিটমহল আন্দোলনের কর্মী</span></span></span></span></p> <p> </p>