<p>শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম এক সময় বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন তুলেছিল তাঁর উপন্যাসগুলো দিয়ে। বিশেষ করে ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। পাঠকরা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকর্মে মুগ্ধ হয়ে তাঁর বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করেন।</p> <p>এরই মাঝে ঘটতে থাকে এক অদ্ভুত ঘটনা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি উপন্যাস ‘চাঁদমুখ’ বাজারে আসে, তবে শরৎচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ও প্রকাশকেরা এতে অবাক হয়ে যান, কারণ তারা জানতেন শরৎচন্দ্র এই বইটি লেখনি। তাঁর প্রকাশকরা ক্ষুব্ধ হলেন এবং অনুসন্ধান শুরু করলেন।</p> <p>আসল ঘটনা তখন প্রকাশ পায়—কেউ একজন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে বাজারে বই প্রকাশ করছেন। পাঠকরা বেশিরভাগই বুঝতে পারছিলেন না আসল শরৎচন্দ্র কে এবং এই নতুন লেখক কে। এমনকি শরৎচন্দ্রের নামে ‘হীরক দুল’ এবং ‘শুভ লগ্ন’ নামে দুটি বইও বাজারে এলো।</p> <p>এমনকি এই ‘নকল’ শরৎচন্দ্রও আসলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামের একজন প্রকৃত ব্যক্তি ছিলেন, তবে তিনি ছিলেন ‘গল্পলহরী’ পত্রিকার সম্পাদক। অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে তিনি নিজের নামের সমসাময়িক জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামের সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেন। যেহেতু তাঁর নামও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পাঠকরা তেমন কোনো সন্দেহ করছিলেন না। এভাবে তিনি কয়েকটি বই লিখে ফেললেন এবং যথেষ্ট পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করলেন।</p> <p>আসল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথমে এই ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তিনি মনে করতেন, পাঠকরা নিশ্চয়ই তাঁর লেখার মান এবং স্টাইল দেখে আসল-নকল বুঝতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। নকল লেখকের বইও ভালো বিক্রি হচ্ছিল এবং পাঠকরা বিভ্রান্ত হচ্ছিল।<br /> শেষমেশ এই সমস্যার সমাধানের উপায় খুঁজতে আসল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বাতায়ন’ পত্রিকার সম্পাদক অবিনাশ ঘোষাল-এর সাহায্য নিলেন। অবিনাশ তাঁর খাস বন্ধু ছিলেন। নানা ধরনের আলোচনা ও পরিকল্পনার পর অবিনাশ ঘোষাল নিজেই নকল লেখকের কাছে যান এবং তাকে নাম পাল্টানোর জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু নকল শরৎচন্দ্র তা প্রত্যাখ্যান করেন।</p> <p>তবে শেষ পর্যন্ত একটি যৌক্তিক সমাধান বের হয়। নকল শরৎচন্দ্র প্রস্তাব দেন যে তিনি তাঁর বইয়ের মলাটে নিজের ছবি ছাপাবেন এবং আসল শরৎচন্দ্রও তা করবেন। এতে পাঠকদের বিভ্রান্তি দূর হবে। নকল শরৎচন্দ্র তার বইয়ের মলাটে ‘শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জুনিয়র)’ লিখে একটি দাড়িযুক্ত ছবি ছাপালেন।</p> <p>আসল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্যও এটি ছিল এক নতুন সমস্যা। তাঁরও দাড়ি ছিল, তবে ফ্রেঞ্চকাট। যদি দুজনেরই দাড়িযুক্ত ছবি থাকে, তাহলে মানুষ তাঁদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। শেষমেশ, আসল শরৎচন্দ্র তাঁর দাড়ি ফেলে দিলেন এবং তাঁর বইয়ের মলাটে একটি নতুন ছবি ছাপালেন।</p> <p>এই পুরো ঘটনাটি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে এক বিরল নজির স্থাপন করেছে। একই নামের দুই লেখকের মধ্যে এমন জটিলতা পাঠকদেরও বিভ্রান্ত করেছিল। তবে শেষে তারা নিজেদের মধ্যে সমাধান করে নেয়, এবং বাংলা সাহিত্যে এই ঘটনা এক প্রবাদ হিসেবে রয়ে গেছে। আসল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য প্রতিভা অবশ্যই প্রশ্নাতীত ছিল, আর এই ঘটনা তাঁর জনপ্রিয়তা ও সৃজনশীলতার প্রমাণ হিসেবে থেকেই গেছে।</p> <p>সূত্র: সম্পদকের বৈঠকে/সাগরময় ঘোষ</p>