<p style="text-align:justify">ঢাকা কলেজে পড়ার সময় ক্লাসের ফাঁকে বলাকা সিনেমা হলে গিয়ে ইংরেজি যে মুভিটি দেখেছিলেন, সেটির নাম ছিল ‘মাস্ক’। এটি ১৯৯৪ সালের ব্যবসা সফল কমেডি ঘরানার আমেরিকান মুভি ‘মাস্ক’ নয়। মুভিটি ছিল সিরিয়াস ঘরানার। মুভিতে মাস্ক পরে নায়ক শুয়ে পড়ার পর কল্পনায় অবিশ্বাস্য যেসব ঘটনা ঘটতে থাকে তার প্রভাব অবচেতন মনে গভীর রেখাপাত করে, ক্রমে যা রূপ নেয় দারুণ এক নেশায়।</p> <p style="text-align:justify">কাজে কিংবা বেড়াতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যখন যেখানে পৌঁছেছেন, সময় বের করে খুঁজে বেড়িয়েছেন মাস্ক বা মুখোশ। সংগ্রহ করেছেন পছন্দের মুখোশ। শখের বশে সংগ্রহ শুরু করলেও বর্তমানে সেটিই হয়ে উঠেছে দারুণ এক মুখোশের সংগ্রহশালা।</p> <p style="text-align:justify"><img alt="মুখোশে শুভ-অশুভের অভিব্যক্তি" height="469" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/04-09-2024/2.jpg" style="float:left" width="316" />আলমগীর রহমান দেশের প্রকাশনাজগতের অতি পরিচিত নাম। সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা অবসর ও প্রতীকের স্বত্বাধিকারী তিনি। ঈর্ষণীয় বন্ধু ভাগ্য তাঁর। তাঁর বন্ধুর তালিকায় রয়েছেন দেশের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি। মুখোশ সংগ্রহের এই নেশার কথা জানাজানি হলে বন্ধুরাও দেশের বাইরে গেলে তাঁর জন্য নিয়ে আসতে থাকেন বিচিত্র সব মুখোশ। এভাবে তাঁর বাসাটি হয়ে ওঠে মুখোশের অনন্য এক সংগ্রহশালা।</p> <p style="text-align:justify">ধানমণ্ডির বাসভবনে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল পাশ থেকে তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা জামান বলেন, ‘একবার ওর জন্মদিনের আগে পল্টন মার্কেটে গিয়েছিলাম ওর জন্য কিছু একটা কিনতে। উপহারটা ঠিক কী দেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ওই সময় এক দোকানে চমৎকার একটি মুখোশ দেখতে পাই। কিনে ফেলি। বাসায় এসে যখন ওকে সেটি দিলাম কী যে খুশি হয়েছে!’</p> <p style="text-align:justify">বয়সের সঙ্গে নানা রোগবালাই জেঁকে ধরেছে আলমগীর রহমানকে। এখন আর তেমন বাসা থেকে বের হতে পারেন না। একসময় অনেক বন্ধু মিলে বাসায় জম্পেশ আড্ডা হতো। একে একে সেসব বন্ধুর অনেকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কেউ বা তাঁর মতোই শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত। পারকিনসন্সে আক্রান্ত হওয়ায় তিনিও সন-তারিখ কিংবা কারো নাম মনে রাখতে পারেন না। যখন-তখন ভুলে যান। আবার হঠাৎ হঠাৎ মনেও পড়ে।</p> <p style="text-align:justify">‘ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার এক বন্ধুর বাবা নেপালে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মরত ছিলেন। ওই বন্ধুর সঙ্গে একবার নেপালে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওই সময় দুটি মুখোশ সংগ্রহ করি। বলা চলে সেটিই প্রথম। বর্তমানে আমার সংগ্রহে চারটি মহাদেশের অন্তত ২৫টি দেশের তিন শতাধিক মুখোশ আছে। শুরুতে বেশ এলোমেলো অবস্থায় ছিল মুখোশগুলো। বাসা ছিল পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। পরে ধানমণ্ডির এই বাসায় চলে আসি। এখানেও শুরুতে মুখোশগুলো ঠিকভাবে গুছিয়ে রাখা ছিল না। পরে এলোমেলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুখোশগুলোর একটা হিল্লে করে আমার স্ত্রী আর ছেলে প্রতীক। কিন্তু জায়গার সংকট আছে। মুখোশ সংরক্ষণ করতে বেশ জায়গা প্রয়োজন।’</p> <p style="text-align:justify">কথার এক পর্যায়ে আলমগীর রহমানের ছেলে প্রতীকও এসে যোগ দেন। ‘বাবার মুখোশ সংগ্রহের কথা জানার পর বাবার বন্ধুরাও তাঁকে মুখোশ উপহার দিতে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর স্ত্রী শাওন, আসাদুজ্জামান নূর, অধ্যাপক শফি আহমেদ, ফারুক মইনউদ্দীন, গোলাম মুরশিদ—এঁরাও অনেকগুলো মুখোশ বাবাকে উপহার দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরাও বাবার শখের কথা জেনে বেশ কিছু মুখোশ উপহার দিয়েছেন। এভাবেই এই সংগ্রহটা গড়ে উঠেছে।’</p> <p style="text-align:justify">বিশ্বজুড়েই মুখোশ এক অনন্য চিত্রকলা হিসেবে সমাদৃত। বাংলা অঞ্চলেও মুখোশশিল্পের যথেষ্ট কদর রয়েছে। সুপ্রাচীন কাল থেকে মুখোশ মঙ্গল-অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে। অদৃশ্য ও কল্পিত বিষয়কে মুখোশের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। বাংলা অঞ্চলে মোটামুটি সাত ধরনের মুখোশচিত্র আছে। পৌরাণিকী মুখোশ, লোকায়ত মুখোশ, গ্রামীণ মুখোশ, প্রাণী মুখোশ, সামাজিক মুখোশ, মিশ্র মুখোশ ইত্যাদি। লোকায়ত নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠানে মুখোশের ব্যবহার দেখা যায়। নৃত্যে মুখোশের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় নর-নারীর বীরত্বব্যঞ্জক, কামভাব বা সম্মোহন ভাবের অভিব্যক্তি। নানা অশুভ প্রভাব দূর করতে, শুভকে আহ্বানে শত শত বছর ধরে সংস্কার ও বিশ্বাস অনুযায়ী আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয় মুখোশচিত্র। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখে চারুকলার শোভাযাত্রায় অশুভকে দূর করে শুভকে আহ্বানে নানামাত্রিক মুখোশচিত্রের ব্যবহার দেখা যায়।</p> <p style="text-align:justify">এ ছাড়া বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে লৌকিক ও পৌরাণিক গল্পের হাসি-তামাশা, বিদ্রুপ, ভয়ভীতি প্রকাশে মুখে মুখোশ লাগিয়ে অভিনয় কিংবা নৃত্য পরিবেশন করা হয়। পিকিং অপেরার অন্যতম অনুষঙ্গ মুখোশ।</p> <p style="text-align:justify">আলমগীর রহমান যোগ করেন, ‘মুখোশ সংগ্রহ করা সহজ কাজ নয়। দামের পাশাপাশি বহন করাও বেশ ঝামেলা। লাগেজে নিলে অনেক সময় ভেঙে যায়। নয়তো আলাদা লাগেজের প্রয়োজন হয়। এসব কারণে এখন আর আমি বন্ধুদের মুখোশ আনতে বলি না। নিজেও আর বিদেশে যাই না। ব্যক্তি পর্যায়ে হয়তো এই শহরে কারো কারো কাছে কিছু মুখোশ সংগ্রহে আছে। তবে সেটা আমার মতো এত ব্যাপক না। সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে দেশে মুখোশ নিয়ে একটা মিউজিয়াম হলে খুব ভালো হতো।’</p>