<p>‘ভাই, তুমি তো বেঁচে থেকে গাজী হয়েছো। দেখবা, আমি শহীদ হবো।’ গুলিবিদ্ধ বড় ভাই তোফায়েলকে এভাবেই বলেছিল ইমরান। পরিবার তিন দিন তাকে ঘরে আটকে রাখে, তবে কোমল পানীয় আনার কথা বলে মাকে ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে যায় ইমরান। কিন্তু ফিরে আসে লাশ হয়ে।</p> <p>বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হয়েছে হাফেজ মোনায়েল আহমেদ ইমরান। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তার আপন বড় ভাই তোফায়েল আহমেদ। এখনো তোফায়েলের শরীরে ১৮টি গুলি রয়েছে। এক ছেলের শহীদ হওয়ার পর অন্য ছেলের ভবিষ্যৎ ও চিকিৎসা নিয়ে পুরো পরিবার চিন্তিত।</p> <p>ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার রামপুরা গ্রামের বাসিন্দা তোফায়েল ও ইমরান। তোফায়েল ঢাকায় ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করছিলেন। ইমরান হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায় নানার বাড়িতে থেকে একটি মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছিল। এক স্বজনের বিয়ের দাওয়াতে সে বাবা-মায়ের কাছে নারায়ণগঞ্জে আসে। এখানেই সে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়।</p> <p>তোফায়েল ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলার সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ২১ জুলাই একই এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ইমরান। নাসিরনগরের গ্রামের বাড়িতে ইমরানের দাফন সম্পন্ন হয়। তোফায়েল তার বাবা-মায়ের সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় থাকেন।</p> <p>তোফায়েল ও ইমরানের বাবা সোয়াব মিয়া ঢাকায় পুরান কাপড়ের ব্যবসা করেন। মা ইয়াসমিন আক্তার গৃহিণী। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে নারায়ণগঞ্জে মায়ের সঙ্গে এবং বাকি দুজন নানার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত।</p> <p>শনিবার সকালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সোয়াব মিয়া কেঁদে ফেলেন। মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এক ছেলেকে হারালাম। আরেক ছেলের ভবিষ্যৎ কী হবে, আমি জানি না। এখন আর কিছু ভালো লাগে না। গুলিবিদ্ধ তোফায়েলের পড়াশোনা শেষ হলে আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে আসব বলে ভাবছিলাম।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বেসরকারিভাবে অনেক সহায়তা তারা পেয়েছেন, তবে সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি। তবে খোঁজ নেওয়া হয়েছে এবং নাম-ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়েছে। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, তোফায়েলের গায়ে যে ১৮টি গুলি আছে, এর দুটি খুলতে গেলে সমস্যা হতে পারে। বাকিগুলো তেমন সমস্যা নয়। তবে এখনো তিনি ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। কী করবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না।</p> <p>ইয়াসমিন আক্তার বলেন, “আমার বড় ছেলে গুলি খাওয়ার খবর পাই এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। সোহরাওয়ার্দীতে তাকে পাই। তখন ইমরান তার ভাইকে বলে, ‘বেঁচে তো তুমি গাজী হয়ে গেছো, আর আমি শহীদ হবো।' এরপর থেকে সে আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে।”</p> <p>তিনি আরো বলেন, “দুই ভাই শুরু থেকেই আন্দোলনে যেত। আমি না করতাম। মা হিসেবে তো এভাবে তাদের যেতে দিতে পারি না। বলতাম, যদি তারা আন্দোলনে যায়, তাহলে আমিও তাদের সঙ্গে যাব। ইমরানের শিক্ষকদেরও বলেছি যেন তাকে যেতে না দেন। এর মধ্যে সে আত্মীয়ের বিয়েতে নারায়ণগঞ্জ আসে। তোফায়েল গুলি খাওয়ার পর তাকে এক প্রকার ঘরে আটকে রাখি। সে বারবার বলত, ‘কেন তোমরা আমাকে বন্দি করে রাখছো?’ একদিন সে ঠাণ্ডা (কোমল পানীয়) আনার কথা বলে বের হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় আসছে না দেখে অসুস্থ তোফায়েল ও তাদের বাবাসহ বেরিয়ে পড়ি। এক জায়গায় গিয়ে দেখি কিছু লোকের জটলা। কাছে গেলে অনেকে মোবাইল ফোনে দেখায় একটি ছেলে গুলি খেয়েছে। এটাই ছিল আমাদের ইমরান। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তাকে মৃত দেখতে পাই। পরদিন তার লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়।”</p> <p>আহত ইমরানকে হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ইয়াসমিন আক্তার। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল, পুলিশ এসে তাদের গাড়ি আটকায় এবং যাদের নিয়ে যাচ্ছিল তাদের পিস্তল ধরে পুলিশ। পরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তাকে মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে ৪৫ মিনিট আটকে থাকার কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই তিনি মারা যায়।</p>