<p>প্রাইভেট কারচালক মো. বশির (৪০)। ঢাকার মিরপুর-১৩ নম্বর এলাকায় দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। গত ১৮-১৯ জুলাই ডিউটি না থাকায় মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পানি ও শরবত খাওয়াতে যান বশির।</p> <p>গত ১৯ জুলাই দুপুরের পর বাসা থেকে শরবত ও পানি নিয়ে মিরপুর গোল চত্বরে গিয়ে আন্দোলনকারীদের তৃষ্ণা নিবারণ করান তিনি। বিকেল ৫টার পর বাসায় ফেরার সময় সহিংসতার মধ্যে পড়ে পেটে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরে পথচারীরা তাঁকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জোনরেল হাসপাতালে ভর্তি করান। সেই থেকে প্রায় দেড় মাস ধরে যন্ত্রণায় হাসপাতালের বেডে কাতারাচ্ছেন বশির। </p> <p>বশিরের ১৮ বছর বয়সী মেয়ে সাদিয়া আক্তার মিরপুরে ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আর ১১ বছর বয়সী ছেলে মো. আসিক হ্যাভেন ইন্টারন্যাশনালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করে। মূলত নিজের ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা করায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাবা হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়ান। </p> <p>পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে থাকায় সংসারের খরচ ও ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারছেন না তিনি। কবে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন তারও কোনো ঠিক নেই। আর কাজে ফিরতে পারবেন কি না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেকটা অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে তাদের। </p> <p>আহত মো. বশির ভোলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের মিয়ারহাট এলাকার মো. কোব্বাত আলী মালের ছেলে। বর্তমানে তিনি ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের পঞ্চম তলায় সার্জারি ওয়ার্ডের ২৫ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।</p> <p>বশির জানান, তার বাবা-মা নেই। সংসারে অভাবের কারণে ২০০৩ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান। প্রথমে গার্মেন্টসে চাকরি করেন। পরে প্রাইভেট কার চালানো শিখে চাকরি নেন চালক হিসেবে। গত ২২ বছর ধরে ঢাকায় চাকরি করে কোনো সঞ্চয় করতে পারেননি। ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে বাসাভাড়া, সংসারের খরচ ও ছেলে-মেয়ের পড়ালেখা করাতেন। এরপর আর অবশিষ্ট কিছুই থাকত না। আশা ছিল, কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা শিখাতে পারলে চাকরি করে হয়তো বা তার স্বপ্ন পূরণ করবে। মেয়ে সাদিয়া আক্তারকে নার্সিংয়ে পড়ানোর আশা ছিল তাঁর। বুলেটের আঘাতে তার সেই স্বপ্ন এখন স্বপ্নই রয়ে গেল।</p> <p>বশির আরো জানান, আন্দোলনের সময় তার নাভির নিচ দিয়ে একটি গুলি ঢুকে বাঁ পাশের কিডনির পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে তার পেটের ছয়টি নাড়ি ছিঁড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। প্রথমে একটি অপারেশন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সেখানে ইনফেকশন হলে আবারও অপারেশন করা হয়। গত ১৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিজ খরচেই চিকিৎসা নিতে হয়েছে হাসপাতালে। পরবর্তী সময়ে অন্তরর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী হাসপাতাল থেকে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসা ফ্রি দেওয়া হলেও সংসার ও ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচসহ অন্যান্য খরচ চালাতে হচ্ছে ধারদেনা করে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়ার পর পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়দিন লাগবে, নাকি অসুস্থ থাকা লাগে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। </p> <p>এদিকে স্ত্রী হালিমা বেগমও কিডনিজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। প্রতি মাসে তার দেড় থেকে দুই হাজার টাকার ওষুধ লাগে। গত দুই মাসের বাসাভাড়াও দেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে প্রায় এক লাখ টাকার মতো ঋণ হয়ে গেছে। সামনের দিনে কিভাবে তার জীবন চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই বশিরের। যেহেতু তাকে গুলি করে আহত করা হয়েছে, তাই তার ছেলেমেয়ের পড়ালেখার দায়িত্ব এবং তার থাকা-খাওয়া ও সংসার চালানোর মতো ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।</p> <p>স্ত্রী হালিমা বেগম জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের পানি ও শরবত খাওয়াতে গিয়ে গত ১৯ জুলাই বিকেলের দিকে বাড়ি ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হন তাঁর স্বামী। পরে পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান। হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ না লাগলেও দৈনিক ২০০-৩০০ টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। টাকার অভাবে স্বামীর ওষুধ ও ছেলেমেয়ের পড়ালেখা এবং সংসারের খরচ চালাতে পারছেন না তিনি।</p> <p>তিনি আরো জানান, তার মেয়ে সাদিয়া আক্তার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও ছেলে মো. আসিক তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিলেন স্বামী মো. বশির। গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় সংসারের আয়-রোজগার বন্ধ রয়েছে। মানুষের কাছ থেকে ধারদেনা করে কোনো মতে চলছে তাদের জীবন।</p>