<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সমাজসচেতন মহলে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অধুনা অহরহ উচ্চারিত হচ্ছে। তার কারণ সহজেই অনুমেয়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ, বিশেষত চরম দরিদ্র খানাগুলো, তীব্র খাদ্যসংকটে নিপতিত। এই দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা, সেমিনার, কনফারেন্সের কমতি ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু সবই যেন সনাতনি ধারায় রোগ ধরার কৌশল; যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">উৎপাদন, ক্রয়ক্ষমতা, সচেতনতা, পুষ্টিকর খাবার ইত্যাদি বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের একগুচ্ছ সুপারিশ পেশ করা। আবার অনেক ক্ষেত্রে এগুলোর উৎস বহিস্থ অর্থায়নে কনসালট্যান্টদের প্রতিবেদন। এতে খাদ্য ফিবছর নিরাপত্তা প্রশ্নে প্রান্তিক উন্নতি ঘটেছে হয়তো বা, কিন্তু এখনো লাখ লাখ মানুষ অভুক্ত কিংবা আধপেটায় জীবন কাটায়। বলা বাহুল্য, খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত আমাদের এতদিনকার </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আবিষ্কৃত</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> উৎসগুলো যে সঠিক নয় তার প্রমাণ খাদ্যের জোগান বাড়ছে, সরকার বিশেষ বিশেষ কর্মসূচিতে গরিবের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করছে, অথচ মানুষ ধুঁকছে খাদ্যের অভাবে। গলদটা তাহলে কোথায়?</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমার বুকশেলফে সম্প্রতি জায়গা নিয়েছে একটি বই </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হোয়াই নেশনস ফেইল টু ফিড দ্য পুওর : দ্য পলিটিকস অব ফুড সিকিউরিটি ইন বাংলাদেশ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> (দেশগুলো কেন গরিবদের খাওয়াতে ব্যর্থ হয় : বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার রাজনীতি)। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম খাদ্য নিরাপত্তার সার্বিক বিষয় নিয়ে লিখেছেন ৩১৩ পৃষ্ঠার হার্ড কাভার বইটি (মনোহর ২০২২)। তাঁর বইয়ে অর্থনীতি, রাজনীতি ও ইতিহাসের বাতাবরণে মোট সাতটি অধ্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে রয়েছে বিস্তৃত ও চমকপ্রদ বিশ্লেষণ। লক্ষ করি, পরিমাণ ও গুণগত পদ্ধতি অবলম্বনে লেখা বইটির উদ্দেশ্য কিছুটা ব্যতিক্রমী। মূলত রাজনৈতিক অর্থনীতির পদ্ধতি (পলিটিক্যাল ইকোনমি অ্যাপ্রচ) ব্যবহার করে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকা পর্যালোচনা করা হয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আর তাই বইটি দাবি করছে যে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকড়ে গভীরভাবে প্রোথিত কারণটি হচ্ছে স্বয়ং রাষ্ট্রের প্রকৃতি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">নেচার অব বাংলাদেশ স্টেট এবং তার সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সংযোগ ঘটায় সেগুলো। লাখ লাখ মানুষ অভুক্ত থাকে দেশটিতে, যা সম্পদের অপ্রতুলতার জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রকৃতির  কারণে। তিনি মনে করেন, নিওপেটরিমনিয়াল বাংলাদেশ রাষ্ট্রে (</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">neopatrimonial state</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">) দুর্বল প্রশাসনিক ক্ষমতা, অকার্যকর প্রতিষ্ঠান ও সংগতিপূর্ণ চিন্তারীতির অভাবে উন্নয়নমূলক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সরকারি প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়। উদ্বেগ আরো যে সরকারের যতটুকু দক্ষতা আছে তা-ও ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু বিধায় জনগণের দোরগোড়ায় সেবার নাম হয় </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সোনার হরিণ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাংলাদেশের এই নিওপেটরিমনিয়াল সরকারগুলো বেঁচে থাকে পৃষ্ঠপোষকতামূলক রাজনীতিতে, যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিনিময় সম্পর্ক সরকারের করণীয় নির্ধারণ করে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বইটির কিছু পর্যবেক্ষণ হৃদয় কাড়ে, মনে হয় বুঝি বা আমাদেরই মনের কথা। লেখক মনে করেন, বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনার নামে যা চলে তা নিছক রাজনৈতিক, লোক-দেখানো; আসল কার্যকারণ নিয়ে মাথাব্যথা খুব কম এবং রাজনৈতিক লাভালাভ সর্বোচ্চকরণে নিবেদিত। এর ফলে জননীতি বাজারে দক্ষতা বৃদ্ধিতে অক্ষম। দুই, হোক সে সরকারি খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা, ভূমি সংস্কার, প্রশাসনিক ক্ষমতা বৃদ্ধি, নীতিমালা বাস্তবায়নে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আংশিক সংস্কার</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> ধারণা ফাঁদ পাতে এবং এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থতা হয়ে ওঠে অনিবার্য। তিন, বাংলাদেশ এমনিতেই একটি দুর্বল রাষ্ট্র, তার ওপর নিওপেটরিমনিয়াল কাঠামোতে তোষণমূলক রাজনীতি এবং নিম্নমানের আমলা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে অধিকতর সংকুচিত করে রাখে। চার, রাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতার পাশাপাশি প্রাক-ঔপনিবেশিক প্রথাগুলো সমাজ ও রাষ্ট্রের সংযোগ দুর্বল করে রেখেছে, যার ফলে সমাজের জন্য নীতিমালা বাস্তবায়ন অনেকটাই অধরা থাকছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বইটির বেশ কিছু জায়গা দখল করেছে খাজনা খোঁজা (রেন্ট সিকিং), দুর্নীতি ও </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অপশাসন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">; চাঁদাবাজি এবং বাজারের ব্যর্থতা, পরিসংখ্যানগত ত্রুটি প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তর তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক ও প্রায়োগিক পর্যালোচনা। এগুলোর দাপুটে  উপস্থিতিতে খাদ্যলভ্যতা এবং খাদ্যে প্রবেশগম্যতা হুমকির মুখে বলে মনে করেন বইয়ের লেখক। যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">খাজনা খাওয়া এবং সরকারি স্তরে দুর্নীতির জন্য সরকারি  হস্তক্ষেপ, বিশেষত খাদ্য বিতরণে এবং সংগ্রহে প্রত্যাশিত ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারেনি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলামের লেখা বইটি নীতিনির্ধারক তো বটেই, সমাজবিজ্ঞানীদের জন্য আশু পাঠ্য বলে মনে করি। খাদ্যসংকট সম্পর্কিত চলমান ডিসকোর্সে এর অবদান অপরিসীম। এতে আছে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের পর্যালোচনা এবং সম্ভবত খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে সরকারি অবদানের ওপর বিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনার প্রথম প্রয়াস। শুধু কারিগরি তথা অর্থনীতির লেন্সে বইটি লেখা হয়নি, একটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়েছে বলা যায়। উঁচু মানসম্মত এ বইটির বাংলা ভার্সন আশা করছি।</span></span></span></span></p>