<p>অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশি ঋণ আকর্ষণে আইনি সুরক্ষা যেমন ইতিবাচক ফল দিচ্ছে; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার এবং বিভিন্ন সংস্থার নেতিবাচক রেটিং বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আকর্ষণীয় সুদহার নির্ধারণ করা কঠিন। তবে কান্ট্রি রেটিংয়ের উন্নতি করার বিকল্প নেই। সম্ভাবনাময় অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রমের সর্বনাশ করতে পারে এই রেটিং। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে রেটিং উন্নতিতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।</p> <p>ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অফশোর ব্যাংকিংয়ের তহবিল আনার জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত বেশি সুদ পাওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল দিত। কিন্তু গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদহার বেশ চড়া। এ কারণে অফশোর ব্যাংকিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।</p> <p>এ ক্ষেত্রে ‘কান্ট্রি রেটিং’ বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুডিস, পিচ, এসঅ্যান্ডপির মতো আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের রেটিং অবনমন করেছে। অথচ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল দেওয়ার ক্ষেত্রে কান্ট্রি রেটিং দেখে। এ জন্য অফশোর ব্যাংকিংকে জনপ্রিয় করতে হলে অবশ্যই কান্ট্রি রেটিংয়ে উন্নতি ঘটানোর পরামর্শ দিয়েছে তারা। যার উন্নতির জন্য সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।</p> <p>জানা গেছে, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সীমিত পরিসরে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটেছে গত এক দশকে। তবে শঙ্কার কারণ হচ্ছে, প্রবাসী ও বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশের অফশোর ব্যাংকিং খুব বেশি আকর্ষণীয় করা যাচ্ছে না। বরং ডলার সংকটের প্রভাবে গত দুই বছরে অফশোর ব্যাংকিংয়ের সম্পদের আকার সংকুচিত হয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ দেশের ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিংয়ের সম্পদের আকার ছিল প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। এখন তা সাত-আট বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আবার এ-ই যখন পরিস্থিতি, তখন বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া সুদহার।</p> <p>অফশোর ব্যাংকিং ও ডলার আহরণ প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ার কারণে প্রতিবছরই বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হয় বাংলাদেশকে। যার মাধ্যমে ব্যাবসায়িক লেনদেন সম্পন্ন করে ব্যবসায়ী সমাজ ও সরকার। এই মুহূর্তে দেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার।</p> <p>বর্তমানে ১০টি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ আসছে। ব্যবসার প্রয়োজনে করোনার আগে ও পরে সরকার-ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ সহায়ক হিসেবে এ ঋণ নিয়েছেন। তালিকায় থাকা শীর্ষ দেশগুলো হলো—সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন ও জাপান।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের। দেশটি গত মে মাস পর্যন্ত এ খাতে ঋণ দিয়েছে ২.০২ বিলিয়ন বা ২০২ কোটি ডলার। গত এপ্রিলে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৯৮ বিলিয়ন বা ১৯৮ কোটি ডলার। অর্থাত্ এক মাসের ব্যবধানে দেশটির বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে চার কোটি ডলার বা ২ শতাংশ।</p> <p>দেশের বেসরকারি খাতকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। দেশটি গত মে মাস পর্যন্ত এ খাতে ঋণ দিয়েছে ১.৭১ বিলিয়ন বা ১৭১ কোটি ডলার। এক মাস আগে এপ্রিলে ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৭৮ বিলিয়ন বা ১৭৮ কোটি ডলার। অর্থাত্ এক মাসের ব্যবধানে দেশটি থেকে ঋণ কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ।</p> <p>গত মে মাস পর্যন্ত তৃতীয় অবস্থানে থাকা হংকংয়ের বিনিয়োগের পরিমাণ ১১০ কোটি ডলার। আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১৩ কোটি ডলার। অর্থাত্ কমেছে তিন কোটি ডলার বা ২.৬৫ শতাংশ।</p> <p>দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে চীন। গত মে পর্যন্ত দেশটি এ খাতে ঋণ দিয়েছে ৯৩.৭৭ কোটি ডলার। আগের মাস এপ্রিলে ছিল ৮৯.৩৪ কোটি ডলার। অর্থাত্ ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।</p> <p>পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। গত মে পর্যন্ত ভারত বেসরকারি খাতে ঋণ দিয়েছে ৭২ কোটি ৫২ লাখ ডলার। আগের মাস এপ্রিলে যার পরিমাণ ছিল ৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার। অর্থাত্ ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।</p> <p>এ ছাড়া দেশের বেসরকারি খাতে গত মে মাস পর্যন্ত ঋণ বিতরণে শীর্ষ দশে থাকা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্য ৭০ কোটি ৬০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র ৬৫ কোটি, জার্মানি ৬২ কোটি, স্পেন ২১ কোটি ও জাপান ১৮ কোটি ডলার দিয়েছে।</p> <p>তথ্য বলছে, প্রতিবছর বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা ব্যাংক খাতের মাধ্যমে ২৩ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। এসব রেমিট্যান্স প্রবাসীদের নিজের হিসাব কিংবা স্বজনদের হিসাবে জমা হয়ে নগদ টাকায় রূপান্তর হয়। কোনো প্রবাসী চাইলেও দেশ থেকে রেমিট্যান্সের কোনো অর্থ প্রত্যাবাসনের সুযোগ থাকে না। এখন প্রবাসীদের জন্য ডলারে আমানত রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় মুনাফাও দেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসাবে মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন ডলারও জমা হচ্ছে। কারণ দেশীয় ব্যাংকেই আন্তর্জাতিক হিসাব খোলার সুযোগ থাকায় বিদেশে অবস্থান করা সত্ত্বেও তাঁর যদি ডলার প্রয়োজন হয়, তিনি এই হিসাব থেকে তাঁর অর্থ তুলে নিতে পারছেন। আবার যত পরিমাণ খুশি তা জমাও রাখতে পারছেন। এর ফলে দেশীয় ব্যাংকগুলোর এই অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সঞ্চিত অর্থ বিদেশি মুদ্রার সংকট দূর করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।</p> <p>জানা যায়, অফশোর ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নিয়ে দেশে বেশ কিছু প্রডাক্ট আগে থেকেই চালু ছিল। সেখানে এখন নতুন করে আন্তর্জাতিক ব্যাংক হিসাব নামে একটি ডিপোজিট সেবা চালু হয়েছে, যা বিশ্বের যেকোনো স্থানে বসেই অফশোরের ব্যাংক হিসাব খোলার পাশাপাশি সেটি পরিচালনা করার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশিরাও এ সুযোগ নিতে পারবে। তা ছাড়া বর্তমানে এ ব্যাংক হিসাবে মুনাফার হার খুবই আকর্ষণীয়। ডলারের ক্ষেত্রে যা বার্ষিক সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার হিসাবধারীর অ্যাকাউন্টে এ সুদও মিলবে বৈদেশিক মুদ্রায়। অন্যদিকে আমানতের সুদকে সরকার সম্পূর্ণ করমুক্ত আয় ঘোষণা করেছে। বিশ্ববাজারের সুদহারের তুলনায় দেশে সরকারের এসব ঘোষণা নিঃসন্দেহে বেশ লাভজনক।</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরো জানান, অফশোর ব্যাংকিংয়ের সুবিধা নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশই তাদের ডলার সংকটসহ আর্থিক খাতের সংকট দূর করতে সক্ষম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোশান ডিজিটাল অ্যাকাউন্টকে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ বলে বিবেচনা করা হয়। এর মাধ্যমে প্রবাসী পাকিস্তানিদের ডিজিটাল ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া হয়। দেশটির প্রবাসী জনগোষ্ঠী প্ল্যাটফরমটি ব্যবহার করে দেশের ব্যাংকের সঙ্গে হিসাব পরিচালনা করতে পারে।</p> <p>২০২০ সালে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এটি শুরু করেছিল। বর্তমানে ১৪টি ব্যাংক এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে এর বিপরীতে বাংলাদেশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা সত্ত্বেও তার পরিপূর্ণ সুফল ঘরে তোলার কাঙ্ক্ষিত স্তরে এখনো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার কিছু সরকারি বন্ড চালু থাকলেও যথাযথ প্রচারণা ও অনলাইন লেনদেনের সুবিধার অভাবে খুব বেশি কার্যকর হয়নি।</p> <p> </p>