<p><strong>নাটাবটেরাদের জগতে মেয়ের কাজ হলো দৌড় দিয়ে সঙ্গী ধরে ঝটিকা প্রণয় সমাপ্ত করে মাটির বাসায় তিন-চারটি ডিম দেওয়া। আর ছেলের কাজ হলো সেই ডিমে তা দেওয়া থেকে ছানা পালনের সব কাজ একাকী চালিয়ে যাওয়া। জাঁদরেল মেয়েটি তখন অন্য বাগানে গিয়ে অন্য ছেলেকে তাড়া করে ধরবে এবং তার বাসায় ডিম দেবে</strong></p> <p>তেঁতুলিয়ার সীমান্তবর্তী চা-বাগানে দেখতে পেলাম একজোড়া নাটাবটেরা পাখি। দেখলাম, দুই সপ্তাহ বয়েসী মুরগিছানার মতো দুটি পাখি ছুটে আসছে। আমরা ছায়াতরুর পিছে আড়াল নিয়ে দাঁড়ালাম। লালচে রঙের ছেলেটি হাঁসফাঁস করে ছুটছে সামনে; যেন ধরা পড়লেই তার প্রাণ যাবে। পেছনে তাড়া করে আসছে কালচে গলার মেয়েটি; যেন ধরতে পারলে সে আজ এই ছেলের হাড়মজ্জা আলাদা করবে। আমরা জানি, এই ধর ধর, মার মার রবে ছোটাছুটির পুরোটাই মেকি। এসব দৌড়ঝাঁপ ওদের পূর্বরাগেরই অঙ্গ। মেয়েটি একসময় ছুটে এসে ছেলের ক্ষুদ্র লেজটি কামড়ে ধরল। বাঁচাও, বাঁচাও বলে ছেলেটি থেমে গেলেই লেজ ছেড়ে দিয়ে মেয়েটি এসে ছেলের পাশে বসল। এই হলো নাটাবটেরার প্রণয়রঙ্গ। এখন থেকে তিন সপ্তাহের জন্য ছেলেটি এই মেয়ের প্রজননসঙ্গী হয়ে গেল।</p> <p>নাটাবটেরাদের জগতে মেয়ের কাজ হলো দৌড় দিয়ে সঙ্গী ধরে ঝটিকা-প্রণয় সমাপ্ত করে মাটির বাসায় তিন-চারটি ডিম দেওয়া। আর ছেলের কাজ হলো সেই ডিমে তা দেওয়া থেকে ছানা পালনের সব কাজ একাকী চালিয়ে যাওয়া। জাঁদরেল মেয়েটি তখন অন্য বাগানে গিয়ে অন্য ছেলেকে তাড়া করে ধরবে এবং তার বাসায় ডিম দেবে। মুরগির মতো পা দিয়ে আঁচড়ে মাটি উল্টে পোকামাকড় খুঁটে খেয়ে নাটাবটেরা পাখির জীবন কাটে। উড়তে সক্ষম হলেও ওড়াউড়িতে দক্ষ নয় এরা। সাপখোপ, শিয়াল-বেজি ইত্যাদি শত্রুবেষ্টিত ভূমিতে বাসা করে বংশ রক্ষা করতে বাধ্য বলে প্রতিবছর কয়েক দফা ডিম দিতে হয় প্রতিটি মেয়েকে। অন্য মেয়েদের মতো কোনো মেয়ে নাটাবটেরা এক পুরুষের কাছে দীর্ঘকাল বিশ্বস্ত থাকার অঙ্গীকার করলে তা হবে আত্মঘাতী। লড়াকু এই নাটাবটেরাদের সংসার দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের জীবনের মতোই নাটকীয়।</p> <p>নাটাবটেরা পাখির মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে আকারে বড়; ওজনে ছেলে ৪০ আর মেয়ে ৬০ গ্রাম। মেয়েরাই মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করে বিচরণভূমি ও প্রজননসঙ্গী দখল করে। সংগ্রামী এই মেয়েদের জন্য পরকীয়াটা কিন্তু জীবনের অঙ্গ; স্খলন নয়। আমাদের অপার সৌভাগ্য, গোবরা নদীতীরে এই নির্জন চা-বাগানে চোখের সামনে এক নাটাবটেরা-দ্রৌপদী তার অর্জুনকে কবজা করল। আমাদের প্রার্থনা, এদের মাটির বাসায় প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা ও শতানীকের মতো ছানা জন্ম নিক। জনাকীর্ণ বাংলাদেশে নাটাবটেরার মতো ভূচর পাখি তো এখন সবই প্রায় শেষ। বংশধারা রক্ষার জন্য এদের প্রতিটি ছানাকে তাই মহা মূল্যবান মনে না করে উপায় নেই।</p> <p>বিশ্বে মোট ১৮ প্রজাতির নাটাবটেরা আছে; যার মাত্র তিনটি প্রজাতি আমরা বাংলাদেশে পেয়েছি। অনেকে এদের ‘গুল্লু’ অথবা ‘গুণ্ডলু’ বলেন; সিলেটে বলা হয় ‘ডাওডুমা’। তেঁতুলিয়ায় দেখা প্রজাতিটির পোশাকি বাংলা নাম ‘দাগি নাটাবটেরা’; ইংরেজিতে ‘বারড বাটনকোয়েল’। ‘বাটনকোয়েল’ নাম এবং গৃহপালিত ‘কোয়েল’ পাখির সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও ওরা পরস্পরের নিকটাত্মীয় নয়। সতের শতকে ব্রিটিশ পাখিবিদ ফ্রান্সিস উইলাবি তৎকালীন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ তথা ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে পাখিটি প্রথম আবিষ্কার করে নাম দিয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়ান কোয়েল’। ‘কোয়েল’ পাখির সঙ্গে এদের বিশাল জেনেটিক পার্থক্যগুলো জানার পর ওই নামটি কিঞ্চিৎ বদলে দিয়ে ‘বাটনকোয়েল’ করা হয়েছে। আমাদের এই গুল্লুটির লাতিন নাম হয়েছে ‘সাসিটেটর’ যার অর্থ ‘জাগরণ’—সর্বদা সজাগ ও সংগ্রামী এই পাখির উপযুক্ত একটি নাম!</p> <p> </p> <p>ক্যাপশন : নাটাবটেরা পাখি। ছবি : লেখক</p> <p> </p>