<p>আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন দল নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে একমত হলেও বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতির নির্বাচনের পরিবর্তে ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ (পিআর) বা ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ পদ্ধতি প্রবর্তনে রাজি নয় দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। আর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও নিজে থেকে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব দেবে না। এই পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন বিধায় সংবিধান সংস্কার কমিশন চাইলে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে এটি যোগ করবে।</p> <p>গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই’ শীর্ষক সেমিনারে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের বক্তব্যে এ বাস্তবতা উঠে আসে। রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) এই সেমিনারের আয়োজন করে।</p> <p>সেমিনারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাট ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ছাত্রসমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।</p> <p>সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি প্রববর্তন বিষয়ে সেমিনারে প্রধান আলোচক হিসেবে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এটা সংবিধান সংস্কারবিষয়ক কমিশন দেখবে। আমরা দলগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব নেব। পিআর পদ্ধতির বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন সিদ্ধান্ত দিলে সেভাবে প্রস্তাব করব।’</p> <p>সংস্কার কমিশন গঠন হওয়ার পর নিজে শ্রোতার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন জানিয়ে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি সব সময় খোলামেলা কথা বলতে পছন্দ করতাম। কিন্তু সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে যে কথা বলেছিলাম তা ভুলভাবে প্রচার হওয়াতে বিব্রত হয়েছি। ওই অনুষ্ঠানে আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কি না? আমি বলেছিলাম, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পলায়নপর, তাঁরা মাঠে নেই, তাঁরা যদি সংগঠিত হতে না পারেন, তাঁরা যদি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, তাঁদের যদি ন্যূনতম বাধা দেওয়া না হয়—তখন নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু প্রচার হয়েছে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে।’</p> <p>তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটি অসাংবিধানিকভাবে বাতিল করা হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য। এ জন্য নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ সরকার দরকার, সেটা যেভাবে হোক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী যেন নিরপেক্ষ আচরণ করে সে পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এরপর হলো রাজনৈতিক দল। দল যদি দায়িত্বশীল না হয়, তারা যদি ছলে-বলে-কৌশলে, টাকার খেলা করে, পেশিশক্তি ব্যবহার করে নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করে, গণমাধ্যম যদি সঠিক খবর না দেয় তাহলে সঠিক নির্বাচন ব্যাহত হয়। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন কল্পনাতেই থেকে যাবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। টাকা দিয়ে, পেশিশক্তি দিয়ে যদি ভোটে জিততে চাই, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই থাকবে। তাই যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা সততা, নিষ্ঠা, পেশাদারির সঙ্গে আমাদের প্রস্তাব উত্থাপন করব।’</p> <p>নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করবে অন্তর্বর্তী সরকার। আমাদের এখতিয়ার হলো কতগুলো সংস্কারের সুপারিশ করা। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো এখতিয়ার নেই।’</p> <p>অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বস্ত্র, পাট ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনসহ সার্বিকভাবে রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে পড়েছে। অনেক জায়গায় এই কাঠামো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। কাজেই দায়দায়িত্ব অনেক। অনেক রক্ত ঝরেছে। ৫০০ থেকে ৭০০ মানুষের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই আমরা যদি রাষ্ট্র সংস্কারে কাজ না করতে পারি তাহলে তাদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি হবে।’</p> <p>নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার সম্পর্কে তিনি প্রস্তাব রাখেন, ‘দলের প্রার্থী হতে হলে অন্তত তিন বছর দলের প্রাথমিক সদস্য পদে থাকতে হবে। তৃণমূলে এক-দুই বছর থেকে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এ ছাড়া সংসদে নারী আসন ৫০ জন বা ১০০ জন—যাই করেন এসব আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার দরকার। এটা করা হবে কি না সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।</p> <p>এম সাখাওয়াত হোসেন আরো বলেন, ‘ডিসিরা নির্বাচন করেন এই কথা ঠিক না। আইন অনুসারে ৩০০ আসনে ৩০০ জন রিটার্নিং অফিসার দেওয়া যাবে। ডিসিদেরই রিটার্নিং অফিসার করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নির্বাচন কমিশনকে ভোটের সময় সরকারের ওপর কিছুটা খবরদারির এখতিয়ার দিতে হবে। তিন ধাপে বাছাইয়ের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করা যেতে পারে। তৃতীয় ধাপে পার্লামেন্ট থেকে চূড়ান্ত প্রস্তাব যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। আর প্রথম ধাপে প্রস্তাবিত সবার নামই প্রকাশ করা যেতে পারে।’</p> <p>প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, ‘ড. বদিউল আলম মজুমদারের সামনে কঠিন পরীক্ষা। নির্বাচনব্যবস্থা প্রশ্নে আমরা রাজনৈতিক ঐকমত্যে আসতে পারিনি। দলগুলোর প্রতি এক ধরনের অনাস্থা এসেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই জায়গায় যায়নি যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রয়োজন। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।’</p> <p> </p> <p>রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য</p> <p>সেমিনারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে উচ্চ আদালতের রেফারেন্সে এই সরকার গঠিত হয়েছে; যার ফলে এটি একটি সাংবিধানিক সরকার। বাস্তবতার নিরিখে যেসব বিষয়ে সংস্কার দরকার তা করতে হবে। বাংলাদেশে যে সংকট রয়েছে সেই সংকট মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক। নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বিনা ভোটে কাউকে নির্বাচিত করা উচিত না। প্রয়োজনে পুনর্নির্বাচন করতে হবে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে শিক্ষকরাও সঠিক দায়িত্ব পালন করেননি। অনেক শিক্ষক আওয়ামী লীগের রাতের ভোটের সহযোগী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে আমরা স্কাউটদের, গার্ল গাইডসদের ব্যবহার করতে পারি। নির্বাচনে প্রার্থী হতে সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে অবসর গ্রহণের তিন বছরের বাধ্যবাধকতা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা উচিত।’</p> <p>তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই ব্যবস্থা আগামী ১০০ বছর থাকা উচিত।’</p> <p>নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করে আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, এ পদ্ধতি যৌক্তিক নয়।</p> <p>বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘বিএনপির ওপর অনেক দায়িত্ব। সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি কিন্তু অভিভাবকের পরিচয় দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচিত হলেও পরে অন্যান্য দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। আমাদের সমস্যা অনেক জায়গায়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে।’</p> <p>সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার অভাব আছে বলে দাবি করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘তিন থেকে পাঁচটি নির্বাচন নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হতে হবে। মানসিকতার বদল আইন করার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে না। আমরা একসময় হয়তো একটা জায়গায় পৌঁছাব যেখানে দলীয় সরকারের অধীনেও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে।’</p> <p>জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে। ছোট ছোট দলও সংসদে যেতে পারবে। ক্ষমতায় আসতে পারবে।</p> <p>সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সংবিধান সংস্কার করার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার ফিরিয়ে আনা, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া ও নির্বাচনের প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তন করে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তন জরুরি। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট এবং প্রাদেশিক সরকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে। নির্বাচনে না ভোটের বিধান চালু করতে হবে।’</p> <p>নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির প্রস্তাব এবং না ভোটের বিধান রাখার পক্ষে মত দেন জোনায়েদ সাকী।</p> <p>রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আইনকে আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর করেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘সহজ শর্তে দলের নিবন্ধন দিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংস্কার করা দরকার।’</p> <p>ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনে আমরা পিআর পদ্ধতির ভোট চেয়েছি। আমরা সংবিধানে সংশোধন এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরত আনার পক্ষে। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন প্রথা বাতিলের পাশাপাশি একাধিক দিনে নির্বাচন আয়োজন করা দরকার। বাতিল করতে হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনব্যবস্থা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক প্রথা বাতিল করতে হবে।’</p> <p>আমার বাংলাদেশ-এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সংস্কারের বিষয়টি বড় করে না দেখে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যমান যে আইনি কাঠামো আছে তা ব্যবহার করেও স্বচ্ছ নির্বাচন করা যায়।</p> <p>গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘এ রকম সেমিনারে জাতীয় পার্টিকে ডাকার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি৷ তারা ফ্যাসিবাদের দোসর। ১৪ দলের কাউকে পরিবর্তিত বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় ডাকার সুযোগ নেই।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচন নির্দলীয় করতে হবে। সংসদ নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে।’</p> <p>জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান আদিব বলেন, ‘দলগুলো ফ্যাসিবাদীদের বিচারের চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান সংবিধান বা নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভোট হলে যেই ক্ষমতায় আসুক তারা কিন্তু ফ্যাসিবাদী দানবে রূপান্তরিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে অতি দ্রুত পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যে কিভাবে পৌঁছানো যায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তরুণরা কী চাচ্ছে সেই জায়গা থেকে দলগুলোকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং তরুণদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে।’</p> <p> </p> <p> </p>