<p><strong>মাটি ও মানুষের শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মের ১০০ বছর পূর্তি হলো। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে পশ্চিমে পাড়ি দিয়ে সেখানে প্রদর্শনী করেছিলেন। দেশের বোদ্ধাদের নজর কাড়েন স্বাধীনতার পর মধ্য সত্তরের দশকে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের চিরন্তন সংযোগ রূপায়ণ করেছেন অনন্য নৈপুণ্যে</strong></p> <p> </p> <p>একবিংশ শতাব্দীতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবী। ঠিক এই সময়ে উদযাপিত হচ্ছে বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মশতবার্ষিকী। সুযোগ পেলে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে কিভাবে গড়তে চান, তা-ই যেন দেখার সুযোগ করে দেয় তাঁর সৃজনপ্রয়াস।</p> <p>বিশাল ও আজও মূলত অজানা এই প্রকৃতিতে পৃথিবী যে আলাদা কোনো বিষয় নয়—এই ভাবনাই নানাভাবে আছে সুলতানের কর্ম ও সাধনায়। এতে আরো স্পষ্ট করে আছে মানুষের শরীর ও মনের অনুভূতির অকৃত্রিম প্রকাশ। সর্বজনীন এই ভাষায়ই এক ‘নিখুঁত’ জগৎ সৃষ্টি করেছেন এস এম সুলতান—আমাদের সবার ‘লাল মিয়া’। তাঁর শিল্পকর্মে আছে প্রকৃতিতে মানুষের অবাধ, সুসংঘবদ্ধ আর সুবিন্যস্ত বিচরণের ছবি।</p> <p>শিল্প বিপ্লবের আগে প্রকৃতিনির্ভর কৃষিসভ্যতাকে নির্ভর করে যে মানবসমাজ গড়ে উঠেছিল, তার ঘনিষ্ঠ বিবরণ আছে সুলতানের চিত্রে। সেই সময়কাল এখন আর নেই। সেই সময়ে ফেরাও যাবে না হয়তো। তবে আজও মানুষের জীবন বিকশিত হয় মিলেমিশে সেই একই শরীর আর মনে—এই প্রকৃতিতেই। মানুষের একত্র হয়ে থাকার প্রয়াসও মানবসভ্যতার এক মৌলিক অনুষঙ্গ। যূথবদ্ধতার এই আদিম অভিপ্রায় থেকেই একের পর এক জমিন গড়ে তুলেছেন লাল মিয়া।</p> <p>মাটি ও মানুষের শিল্পী সুলতানের জন্ম তারিখ কবে—এ নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা আছে। প্রকৃত জন্ম সাল কোনটি, সুলতান তা স্পষ্ট করে নিজে বলেননি। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, তা ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট। স্থান নড়াইলের মাছিমদিয়া। এক কৃষক পরিবারে জন্ম হয়েছিল এই মহান শিল্পীর।</p> <p>১৯৪১ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন সুলতান। তিন বছর আর্ট স্কুলে পড়াশোনা করেন। পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে যান সুলতান। যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে প্রদর্শনী হয়েছিল তাঁর ছবির। দেশে ফেরার পর নড়াইলে গিয়ে তিনি শিশু শিক্ষায় মন দেন। জীবনসায়াহ্নে নড়াইলে শিশুদের জন্য ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিল্পী।</p> <p>বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৬ সালে ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে সুলতানের ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়। এ প্রদর্শনীটিই তাঁকে শিল্পরসিকসহ সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। সুলতানের সৃষ্টিকর্মের একটি উল্লেখযোগ্য দিক প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি নিজস্ব রঙের ব্যবহার।</p> <p>সুলতানের মনমানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি একজন অসাধারণ বাঙালির বলে উল্লেখ করেছেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। এক লেখায় তিনি লিখেছেন, ‘জসীমউদ্দীন, জয়নুল আবেদিন, এস এম সুলতান—এঁদের শিল্পকর্ম একান্তই বাংলাদেশের। একান্তই বাংলাদেশের জল-হাওয়াতেই এঁদের শিল্পকর্মের পরিপুষ্টি।’</p> <p>জল-মাটি-হাওয়ায় একটি বিশেষ স্থানের সজীবতা আর নির্যাসই সুলতানের ছবি, যা ক্রমেই শিল্পের সঙ্গে, সৃষ্টির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ক্রমেই করে ঐকান্তিক আর বাস্তব।</p> <p>স্থান মানুষ আর সমাজ গড়ে তোলে—ক্রমেই নিজস্ব করে ‘স্থানীয়’ এক শক্তির জন্ম দেয়। পরতে পরতে সুলতানের ছবি এই শক্তিকে বিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে তোলে। সুলতানের ছবি আসলে প্রকৃতিতে মানুষের সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার ইতিহাস। প্রকৃতির প্রতি অঙ্গীকারই তাঁর ছবির মূলকথা। সুলতানের সৃষ্টি তাই কখনো পুরনো হয় না। তাঁর সৃষ্টি আমাদের আগামী পৃথিবী গড়ার পথ দেখায়—প্রকৃতিতেই বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে।</p> <p>প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যু হয় শিল্পী এস এম সুলতানের।</p> <p> </p>