<p>সারজিস আলম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির তুখোড় যোদ্ধা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস কালের কণ্ঠকে বলেছেন কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের অন্দরের অনেক গল্প। মত দিয়েছেন রাজনৈতিক ইস্যুতেও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন <strong>যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ</strong></p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : শুরুতেই স্বাগত জানাচ্ছি। আপনার বেড়ে ওঠা সম্পর্কে জানতে চাই।</p> <p>সারজিস আলম : আপনাকে এবং কালের কণ্ঠকে ধন্যবাদ। আমার জীবনের প্রথম ১৭-১৮ বছর পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলায় কেটেছে। সেখানেই বাড়ি। ক্লাস ওয়ান থেকে সিক্স পর্যন্ত কেটেছে ঠাকুরগাঁও জেলার রুহিয়া উপজেলায়। আটোয়ারী উপজেলার আলোয়াখোয়া তফসিলি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করি। এইচএসসি পড়েছি বিএএফ শাহীন কলেজ, ঢাকা থেকে। ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছি।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাই।</p> <p>সারজিস আলম : শুরুতে আন্দোলনটি কোটা সংস্কারের দিকেই ছিল। সরকার যদি ছাত্রসমাজের দাবি মেনে নিত তাহলে আন্দোলন সেখানেই শেষ হয়ে যেত। অথচ জোর করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। সরাসরি গুলি করে লাশের পর লাশ ফেলা হয়। এসব দেখে সাধারণ মানুষ রাজপথে নামে। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরকার পতনের এক দফায় চলে যায় আন্দোলন।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে আসলে কী হয়েছিল?</p> <p>সারজিস আলম : ওখানে অত্যাচার যতটা না ফিজিক্যাল, তার চেয়ে বেশি ছিল মানসিক। জেলখানার ছোট একটা রুমে ছয়-সাতজনকে রাখা হয়। রাতে আমাদেরও এভাবে থাকতে হতো। সেখানে আমাদের সঙ্গে ফোন ছিল না। দ্বিতীয় দিনই বলা হলো, ‘তোমরা গার্ডিয়ান ডাকো।’ সকালের দিকে গার্ডিয়ান এলেও রাত ১২টা পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রাখা হয়। ছয় দিনে এক বেলা অভিভাবকদের খাইয়ে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে। অন্যদিকে আমার বাবাকে ফোন করে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন জাহাঙ্গীর কবির নানক।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : ডিবি অফিসে আপনাদের খেতে দেখা গেছে এবং আপনারা একটা স্টেটমেন্ট দেন।</p> <p>সারজিস আলম : আমাদের ছয়জনকে চেয়ার-টেবিল সজ্জিত ছোট একটা রুমে নেওয়া হয়। পরে জানলাম, সেটাই হারুনের ভাতের হোটেল। হারুন বলেন, ‘তোমরা তো আমার ক্যাম্পাসের ছোট ভাই, আজ তোমাদের সঙ্গে খাব।’ আমি বললাম, এখন আপনার মনে হচ্ছে আমরা ক্যাম্পাসের ছোট ভাই, কিন্তু বন্দি করে রেখেছেন গুহার মতো ছোট ছোট রুমে। আমরা খেতে আগ্রহী ছিলাম না। খাবার এলো। দেখলাম, কয়েকজন ডিসি এই দৃশ্যগুলো ভিডিও করছেন। আমাদের জোর করে খেতে বাধ্য করা হয়। একটা রুমে আমরা ডিবি হারুন ও নাহিদকে দেখলাম। নাহিদ স্ক্রিপ্ট দেখিয়ে বলল, এটা পড়তে হবে আমাদের! বন্দুকের নলের মুখে আমরা ছিলাম অসহায়! স্টেটমেন্ট দেওয়ার পর বের হয়েই স্ট্যাটাস দিলাম, আমাদের সংগ্রাম চলবেই।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : ততক্ষণে আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে।</p> <p>সারজিস আলম : বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আমরা ভেবেছিলাম, এত কষ্টের যে আন্দোলন ১ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত নিয়ে এসেছি, সেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে কি না! কিন্তু পরদিন যেভাবে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাই-বোনরা প্রতিরোধ গড়ে তুলল, তা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। প্রত্যেকেই রাস্তায় নেমে এসেছে।</p> <p>কালের কণ্ঠ : সরকারের পতনের মুহূর্তটা কেমন ছিল?</p> <p>সারজিস আলম : আগস্টের প্রতিটি দিনই ঘটনাবহুল। ৩ তারিখে আমরা এক দফার ঘোষণায় গেলাম। ৪ তারিখ একটি প্রগ্রাম ছিল। আমাদের মাথায় কাজ করছিল, কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যদি পুলিশ গুলি চালায় তাহলে যেন একজন সমন্বয়কেরই প্রাণ যায়। অন্যরা যেন আন্দোলনটা চালিয়ে যেতে পারে। এ জন্য আমরা সবাই একসঙ্গে শাহবাগে আসিনি। বিভিন্ন স্পটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলাম। ফোনের ওপর নজরদারি ছিল। ঘোষণা এলো, লং মার্চ হবে ৬ তারিখে। এক দিনের গ্যাপে অনেক কিছুই হতে পারে। ৩০ মিনিটের মধ্যে ডিসিশন হলো, পরশু নয়, কালই লং মার্চ।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : আপনার সেই স্ট্যাটাস!</p> <p>সারজিস আলম : প্রতিটি স্ট্যাটাস দেওয়ার সময় আমাদের শরীর কাঁপছিল। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ, যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। বাড়িতে ফেরার চাপ ছিল, কিন্তু বারবার মনে হয়েছিল, আমি যদি এই জায়গা থেকে চলে যাই, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ থেকে ২০-৩০ বছর পর একজন কালপ্রিট হয়ে থাকব। কাপুরুষ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে মরে যাওয়া ভালো। ৫ তারিখে সকালবেলা, আমরা একের পর এক স্ট্যাটাস দিতে থাকি। বিশ্বাস ছিল, মানুষ নেমে আসবে। শুনলাম, শহীদ মিনারসহ বিভিন্ন জায়গায় গুলি চলছে। স্নাইপার দিয়ে শুট করা হচ্ছে। নেটওয়ার্ক শাটডাউন ছিল। হঠাৎ যখন নেটওয়ার্ক ফিরল, আমি মুখে মাস্ক, মাথায় পতাকা লাগিয়ে বের হই। চেয়েছিলাম, শাহবাগের মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে মাস্ক খুলব। কিন্তু শাহবাগের কাছাকাছি আসার পর জানলাম, শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। যখন মাস্ক খুলি, মানুষ যখন বুঝতে পারে আমি সারজিস, তখন ছাত্র-জনতার যে চিৎকার, বিজয়ের যে আনন্দ সেটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মানুষ কাঁধে তুলে স্লোগান দিতে দিতে কিভাবে আমাদের গণভবনে নিয়ে গেল, টেরই পেলাম না! এটা সত্য, যাঁরা আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন, তাঁদের একজন যদি বিশ্বাসঘাতকতা করতেন তাহলে এই অভ্যুত্থান সফল হতো না।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : নির্বাচন কবে নাগাদ হওয়া উচিত?</p> <p>সারজিস আলম : নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ইমেজের যে বিশাল ক্ষতি হয়েছে সেটি ঠিক করতে হবে। সংবিধানের সংস্কার প্রয়োজন। আমি কখনোই বলি না চার-পাঁচ বছর যৌক্তিক সময়। আবার এটিও মনে করি, ছয় মাস বা এক বছরে সংস্কার করা সম্ভব নয়।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি চাচ্ছেন না। আপনারা কি ভাবছেন?</p> <p>সারজিস আলম : ব্যক্তিগত মতামত যদি দিই, গেস্টরুম বা গণরুম, বাধ্যতামূলক প্রগ্রাম, নেতাকে সালাম দেওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা মধুর ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে থাকা—এগুলো চাই না। আমি হলে সিট পেয়েছিলাম চার বছরে গিয়ে। তিন বছর গণরুমে থেকেছি, চারজনের রুমে ৪০ জন ঘুমিয়েছি। এখন যারা মাত্র ক্লাস শুরু করেছে তারাও সিট পেয়েছে। এটা একটা বিরাট রেভল্যুশন। যদি ক্যাম্পাস থেকে নেতৃত্ব বের করতে চান, তাহলে শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে রাখতে হবে।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : রাজনৈতিক দল গঠনের অভিপ্রায় আছে কি?</p> <p>সারজিস আলম : এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে আমরা আলোচনায় যাইনি। এই মুহূর্তে যেটি অর্জন করেছি, সেটি ধরে রাখায় মনোযোগ দিচ্ছি। আমরা চাই সংস্কার হোক, নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। জনতার সরকার ক্ষমতায় আসুক। তবে একটি কথা বলে রাখি, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল আসা প্রয়োজন। বড় দুটি দলের মধ্যে থাকার যে সীমাবদ্ধতার কালচার, এটি দেশের স্বার্থ, দেশের মানুষের স্বার্থকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামটিকে আমরা বাংলাদেশের জন্য রাখতে চাই। এটি আমাদের আবেগের সঙ্গে থাকুক।</p> <p> </p> <p>কালের কণ্ঠ : ছাত্র-জনতার উদ্দেশে আপনার বার্তা কী?</p> <p>সারজিস আলম : নতুন প্রজন্মের হাত ধরে নতুন বাংলাদেশ এসেছে। আমরা যেন ছোট ছোট, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, দলীয় স্বার্থ প্রাধান্য দিতে গিয়ে একটা দেশের স্বার্থ, মানচিত্রের স্বার্থ, একটা পতাকার স্বার্থকে বিসর্জন না দিই। আমরা যেন এই সুযোগকে কাজে লাগাই।</p> <p> </p> <p> </p>