<p>কর্মস্থলে নিজেদের নিরাপত্তাসহ চার দফা দাবিতে ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেছেন চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে আশ্বাস পেয়ে গতকাল রবিবার সন্ধ্যার দিকে তাঁরা কর্মসূচি স্থগিত করেন। এই কর্মসূচি চলাকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রায় আট ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা বন্ধ ছিল। এতে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে রোগীদের।</p> <p>গত শনিবার রাতে এক শিক্ষার্থী ও একজন কিডনি রোগী মৃত্যুর ঘটনায় অবহেলার অভিযোগ এনে স্বজনরা ঢাকা মেডিক্যালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ওপর হামলা ও হাসপাতাল ভাঙচুর করে। একই রাতে হাসপাতালের ওয়ার্ডে অস্ত্র নিয়ে ঢুকে বহিরাগত দুই গ্রুপ মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটায়। ওই সময় পুলিশ ও সেনা সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকাল থেকেই বন্ধ রাখা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও ভর্তি রোগীদের সেবা কার্যক্রম। ফলে নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়ে দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা।</p> <p>দুপুর ২টার দিকে হাসপাতালে প্রশাসনিক ভবনের সামনে আন্দোলনরত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের পক্ষ  থেকে সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তাঁদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সারা দেশের হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা কর্মবিরতি শুরু করেন। এর মধ্যেই বিকেলে রোগীর মৃত্যুর জেরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।</p> <p>বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূর জাহান বেগম। তাঁর সঙ্গে বৈঠক শেষে বিকেল ৪টার দিকে শর্তসাপেক্ষে কর্মসূচি স্থগিত করেন আন্দোলনকারীরা। তাঁরা জানান, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী সাত দিন সব হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকবে। বৈঠকে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি, মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, হাসপাতালের পরিচালক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক ও সংবাদকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।</p> <p>বৈঠক থেকে বেরিয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা আগের রাতে মারধরের শিকার চিকিৎসক ইমতিয়াজকে দেখতে যান।</p> <p>পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে চিকিৎসকরা কর্মবিরতি স্থগিত করতে সম্মত হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনটা দাবি তাদের—হামলাকারীদের গ্রেপ্তার, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা দিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী মোতায়েন, চিকিৎসা সুরক্ষা আইন করতে হবে। তাঁদের দাবি শুনেছি, কথা বলেছি। আক্রমণকারীদের কালকের (আজ সোমবার) মধ্যে গ্রেপ্তার করা হবে। বাকি দাবিগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। এরপর তাঁরা আপাতত কর্মসূচি স্থগিত করেছেন।</p> <p>উপদেষ্টার বক্তব্যের পর হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হাসপাতালের সব সার্ভিস এরপর থেকে চালু করা হবে। তবে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও পরিচালক বক্তব্য দিয়ে যাওয়ার পরপরই সাংবাদিকদের সামনে আসেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক ডা. মো. আব্দুল আহাদ বলেন, উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে দেশের সব হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিরাপত্তা চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু স্বাস্থ্য উপদেষ্টা তাঁদের জানিয়েছেন, শুধু বিভাগীয় হাসপাতালে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো জনবল আছে। এ কারণে তাঁরা কর্মসূচি শর্তসাপেক্ষে স্থগিত করেছেন।</p> <p>তার মানে হলো একজন চিকিৎসকের নিরাপত্তার জন্য একজন পুলিশ, বিজিবি বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য দিতে হবে। যেসব হাসপাতালে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করবে সেসব হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আমরা চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করব, জরুরি অস্ত্রোপচার হবে। কোনো ধরনের রুটিন সেবা, আউটডোর সেবা চালু থাকবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে না ততক্ষণ ইমার্জেন্সি চালু করা হবে না। তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। যদি ওই সময়ের মধ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার করে জনসমক্ষে না আনা হয় তাহলে আগামীকাল রাত ৮টার পর আবার শাটডাউন চলবে।</p> <p>তিনি বলেন, ‘কর্মসূচির অংশ হিসেবে আগামী সাত দিন সারা দেশের সব হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ থাকবে। এই সাত দিনের মধ্যে আমাদের আরো দুটি দাবি ছিল—এগুলো পূরণ করতে হবে। এর একটি হলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় স্বাস্থ্য পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে। চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় চিকিৎসক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে।’ এর আগে হামলার প্রতিবাদ এবং নিরাপত্তার দাবিতে কর্মবিরতিতে থাকা চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা।</p> <p><strong>সরেজমিন ঢাকা মেডিক্যাল</strong></p> <p>গতকাল সকাল ১০টায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, টিকিট কাউন্টার বন্ধ রয়েছে। বাইরে অপেক্ষায় আছেন অর্ধশত রোগী ও রোগীর স্বজন। প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছেন অন্তত ১০ জন সেনাবাহিনীর সদস্য। জরুরি বিভাগের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, চিকিৎসকের অপেক্ষায় আছেন আরো শতাধিক রোগী। অনেকেই যন্ত্রণায় হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। কেউ আবার মাদুর পেতে বসে আছে। এদের সবারই জিজ্ঞাসা—কখন ডাক্তার রোগী দেখবেন?</p> <p>ভোগান্তিতে পড়া এক রোগীর স্বজন রিপন মিয়া বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আমার ছেলেটা প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। দেখেন এখনো রক্ত পড়ছে, কিছুতেই রক্ত পড়া বন্ধ করা যাচ্ছে না। সকাল ৯টার দিকে হাসপাতালে আসছি, কোনো ডাক্তার নাই। আমার ছেলেটা মারা যাবে, আপনারা আমার ছেলেটাকে বাঁচান।’</p> <p>শিল্পী ও তাসলিমা দুই বোন মাদারীপুর থেকে বাবাকে নিয়ে এসেছেন ভর্তি করাতে। তাঁদের সঙ্গে কথা হয় জরুরি বিভাগের প্রবেশ পথের সামনে। সকাল ৭টায় পিজি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকরা ঢাকা মেডিক্যালে পাঠিয়েছেন বলে জানান শিল্পী। তিনি বলেন, ৮টায় এখানে পৌঁছে দেখি কোনো ডাক্তার নেই। ভোগান্তির কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।</p> <p>শিল্পী বলেন, ‘বাবার শরীর খুবই খারাপ, পিজি হাসপাতালে সিট খালি নেই। তাই ঢাকা মেডিক্যালে রেফার করেন তাঁরা। কিন্তু এখানে এসে দেখি সব বন্ধ। বাবাকে একটু বসতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও কেউ সাড়া দেয়নি।’</p> <p>হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ইনজেকশন, ওষুধ, স্যালাইন, পেসার মাপার যন্ত্রসহ জরুরি যন্ত্রাংশ মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। ১০টি শয্যার সব কটি খালি। দুটিতে গুরুতর দুজন রোগী আছে, তাদের মুখে অক্সিজেন লাগিয়ে রাখা হয়েছে।</p> <p>এখানে কর্তব্যরত দুই নার্স জানান, গত শনিবার রাতে এক কিডনি রোগী মারা গেলে তার স্বজনরাও ইন্টার্ন চিকিৎকদের মারধর করে। এবং এখানে ভাঙচুর চালায়। এরপর থেকে কর্মবিরতিতে যান চিকিৎসকরা। </p> <p>হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,  সকাল থেকে বেশির ভাগ ওয়ার্ডে চিকিৎসকরা আসেননি। নার্সরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে কিছু ওয়ার্ডে চিকিৎসকদের উপস্থিতি দেখা যায়। বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, রোগীরা এসে টিকিট কাউন্টার বন্ধ দেখে ফেরত যাচ্ছেন।</p> <p>সদ্য বিলুপ্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাবেক সহসভাপতি সোহেল রানা রনি জানান, তাঁদের কর্মবিরতি শুরু হয়েছে শনিবার রাত থেকে। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাদের দাবি, যারা এ ঘটনায় জড়িত, সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’</p> <p><strong>যে ঘটনায় কর্মবিরতিতে যায় চিকিৎসকরা </strong></p> <p>ঢাকা মেডিক্যালে শুক্রবার রাতে ভর্তি হওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় শনিবার সকালে। ওই ঘটনায় ওই রোগীর স্বজনরা দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মারধর করে। হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘ওই ছাত্র মারা যাওয়ার পর তার স্বজনরা একজন চিকিৎসককে মারতে মারতে পরিচালকের রুম পর্যন্ত নিয়ে যায়। আমরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎসকের কর্মবিরতি আমরা সমর্থন করছি, আমরা তাঁদের সঙ্গে আছি।’</p> <p>নিউরো সার্জন ডা. শাহনেওয়াজ বিশ্বাস বলেন, ‘গত শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় ২০১ নম্বর ওয়ার্ডে অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন ডা. মাশরাফি। তিনি গুরুতর এক রোগীর অস্ত্রোপচার করছিলেন, এ সময় ছাত্র নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত সেখান থেকে ডা. মাশরাফিকে মারতে মারতে ডিরেক্টর স্যারের সামনে নিয়ে আসে। তাঁকে সেইভ করার জন্য ডা. ইমরান ওখানে যান, তখন তাঁর ওপরও অতর্কিতে আক্রমণ করে। শব্দ শুনে তখন আমি ক্যাথল্যাব থেকে বের হয়ে সেখানে যাই, তাঁরা আমাকেও অতর্কিতে আক্রমণ করে।’</p> <p>ডা. সাব্বির হোসেন বলেন, ‘কালকে রাতে আরো দুটি ঘটনা ঘটে, একটা ঘটনা হচ্ছে—ইমার্জেন্সি রুমে একজন বিষ পান করে আসা কিডনি রোগী মারা যায়। মারা যাওয়ার পরে আমাদের মেডিক্যাল অফিসারের ওপর হামলা চালানো হয়। ইমার্জেন্সি কমপ্লেক্স ওসেক ভাঙচুর করা হয়। তাই আমরা দেখতে পাই, এখানে ডাক্তার ও রোগী কেউই নিরাপদ নয়।’</p> <p>আরেকটি ঘটনা হচ্ছে, ‘গতকাল এক রোগী বিভিন্ন আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ভর্তির কিছুক্ষণ পর একটি গ্রুপ চাপাতি, রামদা হাতে হাসপাতালে প্রবেশ করে। তারা ওই রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত করে এখান থেকে যায়। তাই আমরা দেখছি, এখানে রোগীও নিরাপদ না। আপনারা কোথায় সেবা নিতে আসবেন। এখানে রোগীও নিরাপদ নয়।’</p>