<p style="text-align:justify">‘ওরে কায়দারে কায়দা/কী চমৎকার দেখা গেল/এই বারেতে আইসা গেল/বাংলাদেশের পতাকা আইল/কী চমৎকার দেখা গেল/ঢাকার শহর দেখায় ভালো/মা-বাবাকে বাসবেন ভালো/আমার খেলা সাঙ্গ হলো।’</p> <p style="text-align:justify"><img alt="আনন্দের ফেরিওয়ালা সর্বানন্দ" height="67" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/28-09-2024/u9000.jpg" style="float:left" width="259" />বাক্সের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দেশ-বিদেশের নানা দর্শনীয় স্থান আর ঘটনার ছবি দেখিয়ে প্রেমজুড়ি (খঞ্জনি) আর ডমরু (ডুগডুগি) বাজিয়ে দুলে দুলে সুরেলা বিবরণ দিলেন সর্বানন্দ মধু। আর বায়োস্কোপ দেখে যে যার মতো চলে গেল। রয়ে গেলেন শুধু আনন্দের সওদাগর—বায়োস্কোপওয়ালা।</p> <p style="text-align:justify">বয়স ৮১ বছর। হাঁটাচলা আর বাচনভঙ্গি দেখে তা বোঝার উপায় নেই। মানুষটা সদালাপী। গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া এই বিস্ময় বাক্সের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব প্রায় ৫৫ বছরের।</p> <p style="text-align:justify">অশীতিপর এই ‘যুবক’ এখনো প্রায় ১৫ কেজি ওজনের বায়োস্কোপের বাক্স কাঁধে-পিঠে করে ছুটে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে। তরুণ বয়সে সেই যে মজে ছিলেন বায়োস্কোপের নেশায়, জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও সেই নেশা আর ছাড়েনি সর্বানন্দ মধুকে। সর্বানন্দের জন্ম বরিশালের আগৈলঝাড়ার প্রত্যন্ত পশ্চিম বাগধা গ্রামে, ১৯৪৪ সালে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে মেজো।</p> <p style="text-align:justify">বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। বাবার জোগালি হিসেবে কাজ শুরু করেন কৈশোরেই। এভাবে হয়ে ওঠেন দক্ষ। দেশের নানা প্রান্তে ছুটে যেতেন ঘর তৈরির কাজে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>কবুতরের বাক্স নয়</strong></p> <p style="text-align:justify">মুক্তিযুদ্ধের আগে যশোরের বোনাপোল সীমান্তবর্তী একটি গ্রামে কাজে গিয়েছিলেন সর্বানন্দ। সপ্তাহ দুয়েক ছিলেন। ওই এলাকার এক বায়োস্কোপওয়ালা তখন ভারতে চলে যাবেন। সর্বানন্দের কাছে তিনি নিজের ‘জাদুরবাক্সটি’ বিক্রির প্রস্তাব দেন। যদিও শৈশবে বায়োস্কোপের নেশা ছিল, কিন্তু এখন এই বাক্স দিয়ে কী করবেন? তাই কিনতে চাননি। বায়োস্কোপওয়ালা সর্বানন্দকে বললেন, ‘বাবা, আমার এই বায়োস্কোপটি নে। জীবনে তোর আর কোনো চিন্তা করা লাগবে না।’ মাত্র ১৮ টাকায় বাক্সটি কেনেন সর্বানন্দ। সঙ্গে শিখে নেন বায়োস্কোপ দেখানোর কৌশল।</p> <p style="text-align:justify">বাড়ি ফেরার পর বাক্সটি দেখে খুশি সর্বানন্দের মা। ভেবেছিলেন, ছেলে হয়তো তাঁর জন্য কবুতর পালার বাক্স নিয়ে এসেছে। বললেন, ‘বাবা, ভালো হয়েছে, এটায় কবুতর পালব।’ হাসতে হাসতে সর্বানন্দ বললেন, ‘মা ওটা কবুতরের বাক্স না। এটা দিয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখানো হয়।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>আনন্দ বিলানোই পেশা</strong></p> <p style="text-align:justify">এরপর বায়োস্কোপের নেশা আর কাটে না সর্বানন্দের। এই নেশা তাঁর পেশাও হয়ে উঠল। শিশুদের মাঝে বায়োস্কোপের আনন্দ বিলিয়ে অনেক মজা। যেখানেই বায়োস্কোপ নিয়ে যান, ছন্দ মিলিয়ে বলেন, ‘ভাই রে ভাই, জীবনে যা দেখ নাই/ভালো কইরা দেখ তাই।’</p> <p style="text-align:justify">প্রথম দিন গেলেন পার্শ্ববর্তী কান্দির হাটে। কায়দা করে বায়োস্কোপ দেখালেন। হাট ভাঙার পর দেখলেন সব মিলিয়ে তিন টাকা পেয়েছেন। সেই অনুভূতি প্রকাশে সর্বানন্দ বলেন, ‘আমার আনন্দ যেন আর ধরছিল না!’</p> <p style="text-align:justify">তখন একজন দিনমজুরের মজুরি ছিল মাত্র ৫০ পয়সা। এর পর থেকে নিয়মিতই হাট-বাজার, স্কুল-কলেজের মাঠে বায়োস্কোপ দেখিয়ে যেতে লাগলেন।</p> <p style="text-align:justify">শুরুর দিকে পাঁচ পয়সা, ১০ পয়সা করে নিতেন। এখন সেটা পাঁচ থেকে ১০ টাকায় এসে ঠেকেছে। গ্রামের মা-বোনদের অনেকে বায়োস্কোপ দেখার বিনিময়ে চালও দেন। এভাবে দৈনিক গড়ে পাঁচ-ছয় শ টাকার মতো আসে। মেলা বা কোনো প্রদর্শনীতে গেলে তিন-চার হাজার টাকাও পান।</p> <p style="text-align:justify"><strong>জারিগানের সুরে সুরে দেখান</strong></p> <p style="text-align:justify">সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করেছেন। প্রথম দিকে লাল-সবুজের পতাকা, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান, রাষ্ট্রনায়কদের দেখাতেন। পরে সেই জায়গা দখল করে লাইলি-মজনুসহ বিখ্যাত সব প্রেম কাহিনি, যুদ্ধসহ নানা কিছু।</p> <p style="text-align:justify">সর্বানন্দ বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু পরিবর্তন করেছি। এ জন্য আমাকে অনেক বেশি জানতে হয়। তারপর  সেটা প্রদর্শনের সময় ছন্দ মিলিয়ে জারিগানের সুরে সুরে বলতে হয়। তবেই দর্শক বায়োস্কোপ দেখে আনন্দ পায়।’</p> <p style="text-align:justify">বায়োস্কোপের কলাকৌশলও জানালেন সর্বানন্দ। লাল রঙের চৌকা বাক্স। সামনের দিকে দুই পাশে চোঙার মতো পাঁচটি মুখ। প্রতিটি মুখেই লেন্স লাগানো। আর বাক্সের ভেতর কাপড়ে আঁকা ছবি। কাপড়টা পেঁচানো থাকে পাশের দুটি কাঠিতে। কাঠির ওপরের মাথায় বাক্সের বাইরে লাগানো থাকে একটা হ্যান্ডেল। সেটা ঘোরালে ছবিসহ কাপড়টা এক পাশ থেকে অন্য পাশে পেঁচাতে থাকে। তখন চোঙায় চোখ লাগিয়ে দর্শক দেখতে পায় রঙিন দুনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে করতাল বাজিয়ে সুরে সুরে ধারা বর্ণনা চলতে থাকে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>পুলিশ ধরে নিয়ে গেল</strong></p> <p style="text-align:justify">একবার মাদারীপুর গিয়েছিলেন বায়োস্কোপ দেখাতে। একটা স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সুরে সুরে ছাত্র-ছাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। শুনে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অনেকে এসে ভিড় করে বায়োস্কোপের সামনে। স্কুলের কাছেই থানা। এক অভিভাবকের নালিশে সর্বানন্দকে ধরে থানায় নিয়ে গেল পুলিশ। ওসি সর্বানন্দকে চিনতে পেরে উল্টো পুলিশ কনস্টেবলকে ধমক দিলেন। তখন ওসি সর্বানন্দের হাতে ১০ টাকা দিয়ে বলেন, ‘আপনি চলে যান।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>ধন্য করেছে লাল বাক্স</strong></p> <p style="text-align:justify">জীবনে খুব বেশি কিছুর চাহিদা নেই। তাই বলা চলে বায়োস্কোপের বাক্সের ওপর ভর করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখেই আছেন সর্বানন্দ।</p> <p style="text-align:justify">ব্যক্তিজীবনে তিন সন্তানের জনক সর্বানন্দ। সন্তানদের পড়াশোনা করিয়েছেন। বিয়ে দিয়েছেন। সবই হয়েছে এই বায়োস্কোপ দেখানোর টাকায়। যদিও সন্তানরা কেউ আর এটাকে পেশা হিসেবে নেয়নি। অবশ্য এখন বায়োস্কোপের সেই রমরমা দিনও আর নেই। মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। ঘরে ঘরে টেলিভিশন। তবু সর্বানন্দের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়নি। নিজেকে সুখী মানুষ ভাবেন তিনি। বললেন, ‘অভাবের তাড়নায় একসময় বই-খাতা বিক্রি করে দিয়েছি। তবে এই লাল বাক্স আমার জীবনকে ধন্য করেছে। যত দিন সামর্থ্য আছে, বায়োস্কোপ দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে যাব।’</p>