<p style="text-align:justify">রাজনৈতিক উদ্বেগ ও আস্থাহীনতায় আবারও বড় দরপতনের সাক্ষী হলো দেশের পুঁজিবাজার। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে গতকাল রবিবার পুঁজিবাজারে বড় দরপতনেই লেনদেন শেষ হয়েছে। দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১৪৯.২০ পয়েন্ট কমে সূচকটি ৪৯৬৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থান।</p> <p style="text-align:justify">পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">দরপতনে আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু শেয়ার কেনার ক্রেতা কম। বাজারের টালমাটাল পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা আইসিবিসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে।</p> <p style="text-align:justify">আবার যাঁরা ঋণ করে শেয়ার কিনেছেন, তাঁদের শেয়ারের দাম তলানিতে নেমে যাওয়ায় (নেগেটিভ ইকুইটি) মার্চেন্ট ব্যাংক/ব্রোকারেজ হাউস বিক্রি বা ফোর্স সেল করে দিচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।</p> <p style="text-align:justify">এমন পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় ফোর্স সেল বন্ধ করাসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।  <br />  <br /> <strong>যে কারণে দরপতন</strong></p> <p style="text-align:justify">পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সমন্বয়হীনতা, ব্যাংক খাতে উচ্চ সুদের হার, মার্জিন ঋণের বিপরীতে কেনা শেয়ার বিক্রির চাপ, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা, একের পর এক শ্রমিক অসন্তোষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়াকে দরপতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।</p> <p style="text-align:justify">তাঁরা বলছেন, আগের শেয়ারবাজার কারসাজি চক্রের তৎপরতা, পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন সুশাসনের অভাব, ভালো প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম, ব্যাংকিং খাতে দ্রুত সুদের হার বাড়ানো ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে এই পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে।</p> <p style="text-align:justify">বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স মাত্র চার দিনের ব্যবধানে ৭৮৬ পয়েন্ট বা ১৫ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু এর পর থেকে প্রধান সূচক গতকাল পর্যন্ত ৯৯৫ পয়েন্ট কমে ৪৯৬৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কায় দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক দরপতন ঘটছে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে আবারও অনিশ্চয়তা ও সংঘাতময় পরিস্থিতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে—এমন আশঙ্কায় অনেকে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে পুঁজিবাজারে ব্যাপক শেয়ার বিক্রির চাপ তৈরি হয়েছে, যা দরপতন ত্বরান্বিত করছে।</p> <p style="text-align:justify">জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শেয়ারবাজারে দরপতনের পেছনে চরম আস্থাহীনতা ছাড়া অন্য কোনো কারণ দেখছি না। বাজার যা সংশোধন হওয়ার হয়ে গেছে। একমাত্র আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি ছাড়া বাজার আর বেশি নিচে নামার যৌক্তিক কোনো কারণ দেখছি না। দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। পুঁজিবাজারে যাঁরা বড় বিনিয়োগকারী, তাঁরা চলে যাচ্ছেন ট্রেজারি বিল, বন্ডের দিকে। সেখানে তাঁরা ভালো সুবিধা পাচ্ছেন। এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে যদি আস্থার পরিবেশ না থাকে, তাহলে বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’</p> <p style="text-align:justify">তিনি বলেন, ‘আগে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি অংশ ছিল, যারা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাজারে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে। আবার তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিতে বাজারে দরপতন ত্বরান্বিত করতে ভূমিকাও রাখতে পারে।’</p> <p style="text-align:justify"><br /> <strong>তীব্র দরপতনে চার বছর আগের অবস্থানে সূচক</strong></p> <p style="text-align:justify">গতকাল ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৪৯.২০ পয়েন্ট কমে ৪৯৬৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এর আগে ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর এই সূচকের অবস্থান ছিল ৪৯৭৪ পয়েন্টে।</p> <p style="text-align:justify">গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ১২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসই-৩০ সূচক ৪৮ পয়েন্ট কমে ১৮৩০ পয়েন্টে অবস্থান করছে। এ ছাড়া ডিএসইএস বা শরিয়া সূচক ৩৬ পয়েন্ট কমেছে। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৯৬টি কম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ২৯টির, কমেছে ৩৪১টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ২৬টির।</p> <p style="text-align:justify">এদিকে গতকাল ডিএসইতে লেনদেনও হয়েছে মাত্র ৩০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার, যা আগের দিন থেকে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা কম। গত বৃহস্পতিবার লেনদেন হয়েছিল ৩০৬ কোটি এক লাখ টাকার।</p> <p style="text-align:justify">এদিকে গতকাল অন্য শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) সিএসই সার্বিক সূচক সিএসপিআই কমেছে ২৯৫ পয়েন্ট। সিএসইতে ২০৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ২৩টির দর বেড়েছে, কমেছে ১৭৩টির আর আটটির দর অপরিবর্তিত রয়েছে। গতকাল সিএসইতে চার কোটি ২৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট কেনাবেচা হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলছেন</strong></p> <p style="text-align:justify">সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, মূলধন হারিয়ে আমরা পথের ভিখারি, অথচ এই সরকার আমাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না।</p> <p style="text-align:justify">ব্রোকারেজ হাউসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাজারের নাজুক পরিস্থিতিতে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দামও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বাড়ানোয় তা পুঁজিবাজারে প্রভাব ফেলেছে।</p> <p style="text-align:justify">মিডওয়ে সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান বলেন, ‘শেয়ারবাজারে দরপতনের অন্যতম প্রধান কারণ ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদহার। ভালো ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমানতের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশের ওপরে সুদের হার দিচ্ছে, অন্যদিকে ট্রেজারি রেটও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর প্রভাবে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে গেছে এবং বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’</p> <p style="text-align:justify">পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুদের হার বাড়ায় পুঁজিবাজারের অনেক টাকা ট্রেজারি বন্ডে চলে গেছে। পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফোর্সড সেল বন্ধ রাখতে হবে। এ ছাড়া ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ার কেনা বিনিয়োগকারীদের নতুন করে সুদ আরোপ করা কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখা এবং মন্দাকালীন সুদ মওকুফ করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফোর্সড সেল বন্ধ রাখতে হবে।’</p> <p style="text-align:justify">বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি করছেন, এতে বাজারে বিক্রির চাপ অনেক বেড়েছে। ফলে দরপতন হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থায় বাজারে তারল্য সংকট আছে। এসব সমস্যা মোকাবেলায় কমিশনের পক্ষ থেকে নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে অনেক সভা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। একই সঙ্গে বাজার অস্থির করতে কোনো চক্র কাজ করছে কি না সে ব্যাপারে আমাদের সার্ভেইল্যান্স অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’</p> <p style="text-align:justify">তিনি বলেন, ‘আশা করছি শিগগিরই বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। বাজার এখন যে পর্যায়ে গেছে তাতে অনেক বিনিয়োগকারী আসবেন এবং তাঁরা আগামী দিনে ভালো মুনাফা পাবেন।’</p> <p style="text-align:justify">ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন অনিয়ম এবং নীতি অসংগতির কারণে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এযাবৎকালে অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমানে পুঁজিবাজারের কাঠামোগত সংস্কারে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জসহ বাজার মধ্যস্থতাকারী সব প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করছে। আশা করা যায়, সব সংস্কার কার্যক্রমের সফল সম্পাদন এবং পরিপূরক নীতি সহায়তার মাধ্যমে দেশের পুঁজিবাজার শিগগিরই একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা শুরু করবে।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>দরপতনের কারণ খুঁজতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি</strong></p> <p style="text-align:justify">পুঁজিবাজারের দরপতনের কারণ খুঁজে বের করতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গতকাল এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয়েছে সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শামসুর রহমানকে। অন্য সদস্যরা হলেন : বিএসইসির উপপরিচালক মোহাম্মদ ওয়ারিসুল হাসান রিফাত, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান ও সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কাজী মিনহাজ উদ্দিন।</p>