<p>কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি, হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখী করার কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।</p> <p>আজ রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার পর প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি একথা বলেন। তার আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয়ে এসে চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব নেন তাজুল ইসলাম। </p> <p>একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর তাজুল ইসলাম জামায়াত নেতাদের আইনজীবী হিসেব দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে সেই তাজুল ইসলামই এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর।</p> <p>গত ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ। এছাড়া এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আরো চারজন আইনজীবীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন- মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ ও আবদুল্লাহ আল নোমান।</p> <p>নবনিযুক্ত প্রসিকিউটরদের মধ্যে প্রেস ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম।</p> <p>ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সম্ভাব্য প্রধান অপরাধী দেশ থেকে পালিয়েছেন। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি প্রক্রিয়া আমরা শুরু করব। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অপরাধী প্রত্যার্পণ চুক্তি আছে। ২০১৩ সালে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এই চুক্তি হয়েছিল। তিনি যেহেতু বাংলাদেশে গণহত্যার প্রধান আসামি হবেন বলে মনে করছি, বা অধিকাংশ মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। সতুরাং এ প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে তাঁকে আইনগতভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করব।</p> <p>চিফ প্রসিকিউটর বলেন, অপরাধটা (কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলন) ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সব জায়গায় একইসাথে সংঘঠিত হয়েছে। প্রত্যেকটা জায়গায় একটা কমন ইন্সট্রাকশন (সাধারণ নির্দেশনা) ছিল গুলি করে সব মেরে ফেলার। এ অপরাধের যে আলামত, সেগুলো সংগ্রহ করে কম্পাইল (সন্নিবেশ) করা এটা একটা চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আসামিরা এখনো পলাতক। প্রধান আসামি দেশত্যাগ করেছেন। অনেকে দেশত্যাগের চেষ্টায় আছেন। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা।</p> <p>তাজুল বলেন, আমাদের প্রথম প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) হচ্ছে, এ মামলায় যারা আসামি হবেন তারা এখনো বাংলাদেশে আছেন। অনেকে দায়িত্বেও আছেন। তারা এ আলামতগুলো ধংস করার চেষ্টা করবেন। তাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব এ আলমতগুলো দ্রুত সংরক্ষণ করা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগুলো সংগ্রহ করা। প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার হাতে নিয়ে আসা। যেন এ আলামতগুলো আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে পারি।</p> <p>সব ধরণের আলামত তদন্ত সংস্থা বা প্রসিকিউশনের কাছে পৌছানোর জন্য ছাত্র-জনতাসহ ভুক্তভোগীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এটা এমন একটা বিচার হবে যে, বিচারের পর শহীদ পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, বাদীপক্ষ এমনকি আসামিপক্ষও মনে করবে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়েছে। আসামিদের প্রতি জুলুম করা হবে না আবার ছাড়ও দেওয়া হবে না।</p> <p>আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, এ অপরাধগুলোর মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে তদন্তকালে আসামিদের গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হবে। নিশ্চয়ই আমরা অপরাধীদের গ্রেপ্তার চাইব। আমাদের প্রথম চেষ্টা থাকবে যরা সম্ভাব্য অপরাধী তারা যাতে আদালতের জুরিকিডিকশনের (এখতিয়ারের) বাইরে চলে যেতে না পারেন। সেটা ঠেকানোর চেষ্টা থাকবে।</p> <p>এক প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন, ১৯৭৩ আইন সংশোধন নিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা মাত্র দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমরা সরকারের সঙ্গে বসে এগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব।</p> <p>গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কোটা সংস্কার ও সরকার পতনের আন্দোলনে সারাদেশে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১৩টি অভিযোগ কমপ্লেইন্ট রেজিস্ট্রিভুক্ত করেছে তদন্ত সংস্থা। অভিযোগগুলোর নথি-দালিলিক পর্যালোচনার কাজ চলছে বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন সংস্থার উপপরিচালক মো. আতাউর রহমান।</p> <p>ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট</p> <p>একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসকেরা নিরীহ বাঙালির ওপর বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নসহ মানবতাবিরোধী নৃশংসতা চালায়। মানবতাবিরোধী এসব অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল বা সরাসরি অংশ নিয়েছিল এদেশীয় কিছু দোসর, যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচিত। </p> <p>মানবতাবিরোধী এসব অপরাধের বিচারের জন্য স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। সে হিসাবে যাত্রা শুরুর ১৪ বছর পূর্ণ করেছে ট্রাইব্যুনাল।</p> <p>২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়। এরপর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন এই ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম চলছে। এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪৪টি এবং ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১১টি মামলার রায় এসেছে। </p> <p>রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দণ্ডিত ১৪৯ আসামির মধ্যে ১০৬ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি। তাঁদের মধ্যে ৫০ জন এখনো পলাতক।</p> <p>ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুসারে, এ পর্যন্ত তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ এসেছে ৮৩৩টি, যার মধ্যে ৮৯টি অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে।<br />  </p>