<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ভারত ও চীন পৃথিবীর দুই বৃহত্তম জনবহুল দেশ। এই দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে টহল চুক্তি নিয়ে সাম্প্রতিক সমঝোতা নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রের একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। চার বছরের সামরিক অচলাবস্থার পর দুই দেশ হিমালয় সীমান্তে তাদের বিতর্কিত অংশ নিয়ে একটি টহলব্যবস্থা কার্যকর করতে সম্মত হয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ২১ অক্টোবর এই চুক্তির ঘোষণা দেন, যা ভারত-চীন সম্পর্কের উন্নয়নের দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই চুক্তি ২০২০ সালের সংঘর্ষের আগে দুই দেশের সেনাদের নিয়মিত টহল দেওয়া এলাকাগুলোতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে। ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের আগে আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির এই ঘোষণা আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই চুক্তিকে কি আমরা সত্যি দীর্ঘমেয়াদি শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখতে পারি, নাকি এটি কেবল অস্থায়ী সমঝোতা, যা ভবিষ্যতে আবারও উত্তেজনার ঝুঁকি তৈরি করবে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারত ও চীনের মধ্যে রাজনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান করা জরুরি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা একটি দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক ইস্যু। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে দুই দেশের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""> (Line of Actual Control- LAC) </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রতিষ্ঠিত হলেও সীমান্ত নিয়ে অস্পষ্টতা এবং বিরোধ কখনোই পুরোপুরি মেটেনি। ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষের পর থেকে উভয় দেশের সামরিক বাহিনী দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থায় ছিল। ওই সংঘর্ষে উভয় পক্ষেরই প্রাণহানি ঘটে, যা দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই অচলাবস্থার কারণে সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বেড়ে যায় এবং দুই পক্ষই তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসতে নারাজ ছিল। তবে এই চুক্তি তাদের সামরিক বাহিনীকে সংঘর্ষের আগে যেসব স্থানে নিয়মিত টহল দেওয়া হতো, সেখানে ফেরার সুযোগ করে দিয়েছে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের সেনা প্রত্যাহার এবং স্থিতিশীলতা অর্জনের পথ প্রশস্ত হতে পারে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="ভারত-চীন সীমান্তে টহল চুক্তি কি স্থায়ী শান্তির প্রত্যাশা, নাকি অস্থায়ী সমঝোতা" height="238" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/10.October/25-10-2024/78.jpg" style="float:left" width="321" />ভারত ও চীন এই নতুন টহল চুক্তির মাধ্যমে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় উভয় পক্ষের সেনাদের নিয়মিত টহল কার্যক্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়েছে। চুক্তিটি প্রথমে সামরিক সংঘাত হ্রাসের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর কার্যকারিতা ও দীর্ঘস্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। সীমান্তে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য একটি কাঠামো হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারত-চীনের মধ্যে নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোতে নিয়মিত টহল কাজ করবে, যা উভয় পক্ষের সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">টহল চুক্তি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই চুক্তি মূলত দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও সামরিক স্তরের আলোচনার ফলাফল। এটি সীমান্তে সংঘর্ষ বা অস্থিরতা এড়াতে সহায়ক হবে এবং সীমান্তে একে অপরের প্রতি আস্থা বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভারত ও চীন উভয় দেশের জন্যই এই চুক্তির কৌশলগত মূল্য রয়েছে। চীনের জন্য এটি তার বৈশ্বিক প্রভাব এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। অন্যদিকে ভারতের জন্য এই চুক্তি তার আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করার প্রয়াসের অংশ। চার বছর ধরে ভারত ও চীনের মধ্যকার সামরিক অচলাবস্থা শুধু সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনা বাড়ায়নি, বরং তাদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে। ভারত সরকার চীনা বিনিয়োগের ওপর কড়া নজরদারি আরোপ করেছে এবং বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প স্থগিত করেছে। চীন থেকে প্রযুক্তি এবং নির্মাণ শিল্পে যে বিশাল বিনিয়োগ হয়েছিল, তা প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিশেষত, বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক সব সময়ই কৌশলগত এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চুক্তির ফলে এই সম্পর্ক আবারও নতুন গতি পেতে পারে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ভারত-চীন সীমান্তচুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে উভয় দেশের রাজনৈতিক ইচ্ছা এবং প্রতিশ্রুতির ওপর। টহল চুক্তির মাধ্যমে অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উভয় দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং বিশ্বাস স্থাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের জন্য চীনের সঙ্গে একটি স্থায়ী সমঝোতায় পৌঁছানো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-চীন সীমান্তে টহল চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা ভবিষ্যতে উভয় দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতা আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এই চুক্তি দীর্ঘ মেয়াদে কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে। চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে এই চুক্তির সফলতা নির্ধারিত হবে। চুক্তির মাধ্যমে সাময়িক অচলাবস্থা নিরসন করা সম্ভব হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য উভয় দেশেরই রাজনৈতিক ইচ্ছা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার আশায় এই চুক্তিকে হয়তো ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, তবে এটি বাস্তবে কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই চুক্তিকে শান্তির প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা হলেও বাস্তবিক অর্থে এটিকে একটি অস্থায়ী সমঝোতা বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে। ভারত ও চীন উভয় দেশই আঞ্চলিক শক্তির প্রদর্শন এবং তাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে টহল চুক্তি এক ধরনের বিরতি হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু এটি সমস্যার মূল সমাধান নয়। চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের হুমকি কিছুটা কমানো সম্ভব হলেও বাস্তব সমস্যাগুলো অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে। সীমান্তবিরোধ এবং চীনের সম্প্রসারণমূলক মনোভাব এখনো ভারতকে চিন্তিত করে। একই সঙ্গে চীন ভারতের সামরিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে চুক্তির মাধ্যমে শুধু টহল পরিচালনার নিয়মাবলি নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু মূল সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। চুক্তির মাধ্যমে ভারত ও চীন উভয়েই তাদের কৌশলগত অবস্থানকে মজবুত করার চেষ্টা করছে। ভারত চায় তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী অবস্থান নিতে। অন্যদিকে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং ভারতকে প্রতিযোগী হিসেবে দেখে। চুক্তিটি চীনের জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হতে পারে, যাতে ভারতকে কিছুটা হলেও শান্ত রাখা যায় এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক লক্ষ্য পূরণ করা যায়।</span></span></span></span></p> <p> </p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> লেখক : সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</span></span></span></span></p> <p> </p>