<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শিক্ষকের জায়গা থেকে মাঝেমধ্যে হেরে যেতে ভালো লাগে। প্রায় ৩৬-৩৭ বছর আগের কথা বলছি। আমার এক ছাত্রকে নিয়ে খুব হতাশ ছিলাম। ছাত্রটি মেধাবী, কিন্তু ক্লাসে বেশির ভাগ দিন অনুপস্থিত থাকাটা ওর জন্য নিয়ম ছিল। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের সদস্য। মিছিল-মিটিংয়ের সামনের সারিতে ওর উপস্থিতি থাকত নিয়মিত। ওর একটি ভঙ্গির কথা খুব মনে পড়ে। টিউটরিয়াল পরীক্ষায়ও অনুপস্থিত। পরদিন দেখা হলো করিডরে। ডেকে বললাম, কী ব্যাপার পরীক্ষা দিলে না কেন? ও এক কদম সামনে এসে নিচু স্বরে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বলল, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">স্যার, বিষয়টি নিয়ে আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব!</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> আমি ভাবলাম, হয়তো গুরুতর কিছু হবে। এভাবে কাটল দুই সপ্তাহ। আবারও টিউটরিয়াল পরীক্ষায় ছাত্রটি যথারীতি অনুপস্থিত। দুই দিন পর আবার দেখা। প্রশ্ন করতে একই ভঙ্গিতে একই উত্তর। কিন্তু ওর গুরুতর বিষয়টি আর কখনো জানা হয়নি আমার। আমার ধারণা হয়েছিল, এই ছেলে গোল্লায় গেছে। ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। অনেককাল পরে জেনেছি, আমার এই ছাত্রপ্রবর একটি স্বনামধন্য জাতীয় দৈনিকের সহকারী সম্পাদক। একসময় জানলাম আমার খুব পছন্দের কলাম লেখক এই স্নেহভাজন ছাত্রটিই। কলমি নাম ব্যবহার করায় বুঝতে পারিনি। আর এখন সেই শ্রীমান সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। অর্থাৎ ওর সম্পর্কে আমার প্রাক-ধারণা ফেল করেছে। পুরোপুরি হেরে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এ সময়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে দেখে আমি হতাশ। শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেকেই ব্যর্থ মনে করি। আমরা এই প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তেমন করে জানাতে পারিনি। নানা রাজনৈতিক দখলদারির কারণে ওরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে কোনো প্রেরণা খুঁজে নিতে পারছে না। শিক্ষাক্ষেত্রেও হতাশা অনেক। প্রাইভেট ও পাবলিক উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বড়সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে দেখেছি জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ কমে গেছে। এর চেয়ে সহজে কিভাবে ভালো গ্রেড অর্জন করা যায় সেদিকে মনোযোগ বেশি। এর মধ্যে বেসরকারি আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতা কিছুটা আলাদা। আমি একটি প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নিতে বাধ্য। শিক্ষার্থীদের বড় অংশের জ্ঞানচর্চা থেকে দূরে থাকার সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক রুটিন কড়াকড়িভাবে মেনে চলে। তিন মাস বা পাঁচ মাসের সেমিস্টারে প্রয়োজন থাকলেও অতিরিক্ত সময় দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ পরবর্তী সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হবে সময়মতোই। এ ধারার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা খরচও অনেক। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী ব্যস্ত থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে। তাই বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা থাকে প্রতি সেমিস্টারে বেশি করে কোর্স নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে। এ কারণে তিন-চারটি কোর্সের টিউটরিয়াল, মিডটার্ম, প্রেজেন্টেশন, ফাইনাল</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এসব সামাল দিতে সিলেবাস ও সাজেশনের ছকের ভেতরেই ওরা আটকে থাকে। ফলে লাইব্রেরিতে সময় দেওয়া, জ্ঞান অর্জনের জন্য গভীরভাবে পড়াশোনা করা এবং সিলেবাসের বাইরে একটি-দুটি বই পড়া অনেকের ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। এসব বাস্তবতায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর লক্ষ্য থাকে কিভাবে সীমিত কয়েকটি বিষয় গলাধঃকরণ করে একটি মোটামুটি ভালো গ্রেড অর্জন করা যায়। এমন বাস্তবতায় শিক্ষকদের কারো কারো মধ্যে কিছুটা হতাশা কাজ করে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="হতাশার মেঘ ঠিক কেটে যায়" height="259" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/10.October/18-10-2024/Untitled-1.jpg" style="float:left" width="321" />পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট একটু ভিন্ন। একাডেমিক ক্যালেন্ডার কড়াকড়িভাবে মানার বালাই নেই বলে চাইলে একটু সময় পাওয়া যায়। এই সুযোগে সেশনজট বাড়ারও পথ তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, ছাত্রের চেয়ে শিক্ষকের দায় বেশি। অনেক শিক্ষকের মধ্যে এক ধরনের অসুস্থতা কাজ করছে। এ ধারার শিক্ষকদের ব্যক্তিগত অসাধুতার সঙ্গে নষ্ট রাজনৈতিকীকরণের দায়ও থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকেই রাজনৈতিক সরকারগুলো রাজনৈতিক হীনস্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে শিক্ষাঙ্গনকে জ্ঞানচর্চা আর জ্ঞান সৃষ্টির পীঠস্থান থাকতে দেয়নি। মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষকদের নষ্ট রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হয়। লাল, নীল, হলুদ, সাদা নানা রঙের প্রতীকে শিক্ষক রাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ সৌন্দর্যকে নষ্ট করে ফেলে। এ কারণেই শিক্ষকদের অনেকের মধ্যে ন্যায়নীতিবোধ অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যায় না। ক্লাসে ঠিকমতো উপস্থিত না থাকা, পরীক্ষার ফলাফল তৈরিতে বিলম্ব করা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারা শিক্ষার্থী অনেককেই হতাশ করে তুলছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ছাত্ররাজনীতির নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় এর গৌরব হারাচ্ছে। একসময় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির বিরুদ্ধমতের ছাত্রদের ওপর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আশির দশকে তো শিবিরের ছেলেদের ওপর রগকাটা অভিধা যুক্ত হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল হিসেবে জামায়াত-শিবির বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ শাসনামলে ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আবার যার যার শাসনামলে প্রবল হয়ে যায় ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের ছেলেরা। তাদের কারণে ক্যাম্পাস কলুষিত হয়। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা দলীয় নেতাকর্মী সতীর্থদের হাতে নিগৃহীত হতে থাকে। বাম দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় না থাকায় তাদের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে তেমন প্রভাবশালী নয়। তবু ক্যাম্পাসে আন্দোলনের মাঠে তারা প্রবল। তারা ক্যাম্পাসে পরিবেশ রক্ষা, নানা অনাচার আর উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে প্রবল হলেও ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে খুব কমই আন্দোলন করে থাকে। লাইব্রেরির আসন বৃদ্ধি করা, বই কেনার বাজেট বাড়ানো, নিয়মমতো ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এসব ইস্যুতে আন্দোলন করতে তেমন দেখা যায় না। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতার স্খলন সর্বত্রই প্রবল। এসব বাস্তবতায় দায়িত্ববান শিক্ষকদের মধ্যে একটি হতাশা কাজ করে। এমন সাধারণী করে যখন ভাবি, এভাবে জ্ঞানচর্চা বিচ্ছিন্ন শিক্ষার্থীরা কেমন করে ভবিষ্যৎ গড়বে! ওদের দিয়ে দেশের-দশের মুখ উজ্জ্বল করা কি সম্ভব! এর পরও মাঝেমধ্যে যখন দেখি আমার চিন্তা পরাজিত হচ্ছে, কোনো কোনো শিক্ষার্থী অসাধারণ মেধার পরিচয় রাখছে, তখন ভীষণ আনন্দ পাই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একটি বড় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে, যেখানে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে। একসময় সাধারণ জনগণও যুক্ত হয়েছে। অসাধারণ বিজয় অর্জন করেছে ছাত্র-জনতার বিপ্লব। বিপ্লবোত্তর সময়ে এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই আবার বিষণ্ন করেছে আমাদের। নানা জায়গায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। স্কুল-কলেজে অনেক শিক্ষককে অপমান করেছে। জোর করে পদত্যাগ করিয়েছে। আবার এরাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর শূন্যতায় দক্ষ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রকের মতোই সড়ক নিয়ন্ত্রণ করেছে। তখন আশা জেগেছে, এদের যদি ঠিকমতো পরিচালনা করা যায়, তবে অনেক অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে কয়েকজন বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রকে গুরুত্ব দিলেও অন্যরা মনে করছে, তারা অবহেলার শিকার হচ্ছে। তারা নানাভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে। এমন জটিল অবস্থায় এক-দেড় সপ্তাহ আগে এসবের মধ্য থেকে একটি প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়েছে আমার ভেতর। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা এক শিক্ষার্থীর ভিডিও দেখছিলাম। আমি ভুল না করলে ওর নাম ছিল মিম আক্তার। ২১-২২ বছরের তরুণী। ওর বক্তব্য থেকেই বুঝতে পারলাম জুলাই বিপ্লবে সে রাজপথে ছিল। মেয়েটির চমৎকার বাগ্মিতা আমাকে মুগ্ধ করল। আনন্দ ও হতাশা দুটিই ছিল ওর বক্তব্যে। যখন আমরা হতাশ হচ্ছিলাম এই ভেবে যে মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের গভীরতা ও গৌরবগাথা ভুলে গেছে, তখন সে আমার ভুল ধরিয়ে দিয়ে যেন জানান দিল ইতিহাস চর্চা করে ওদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ঠিক দেখতে পায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ওদের মধ্যেও সঞ্চারিত আছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মেয়েটি এই সময়েরও নানা সীমাবদ্ধতাকে আমলে না এনে সাহসী বক্তব্য দিল। আর ওর কথা শুনতে শুনতে আমার ভেতরের জমাট মেঘ কাটতে শুরু করে। বিশ্বাস হলো, এখনো অনেক কিছু নিঃশেষ হয়ে যায়নি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">shahnawaz7b@gmail.com</span></span></span></span></p>