<p>আর দশজন মানুষ সাফল্যের পেছনে উর্ধ্বশ্বাসে ছোটে। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, উল্টো সাফল্যই যেন পিছু নিয়েছে সাকিব আল হাসানের! কৈশরে পাড়ার ফুটবল মাতিয়ে ঘটনাচক্রে বিকেএসপির ক্যাম্প ঘুরে ক্রিকেটে থিঁতু হওয়া সাকিব অপ্রতিরোধ্য। ক্যারিয়ারের একেবারে শুরুতে, ২০০৬ সালে একবারই বাদ পড়েছিলেন। তাঁর দেড় যুগের আর্ন্তজাতিক ক্যারিয়ারে সেটাকে চাঁদের কলঙ্ক বলা যায় বড়জোর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিনি মহীরুহ। আরেকজন সাকিব আল হাসান আবার কবে দাপাবেন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে, সেই অপেক্ষা অনাদিকাল হওয়াও অসম্ভব নয়।</p> <p>ক্রিকেট রেকর্ডের খেলা। অসংখ্য রেকর্ড নিয়ে নিজে খেলেছেন সাকিব। রেকর্ড তুচ্ছ যদি ম্যাচ জেতানো নৈপুণ্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। সেই ক্যাটাগরিতেও সাকিব বাংলাদেশে অনন্য। অসংখ্য ম্যাচ জিতিয়েছেন বাংলাদেশকে, বিভিন্ন দলকে। অযুত-কোটি ভক্তের মনও জিতেছেন মাঠের সাফল্য দিয়ে। ক্রিকেটীয় সাফল্যের সঙ্গে তারকাখ্যাতির অনুসঙ্গ দর্শনদারী- সব নিয়েই সাকিব বাংলাদেশের মহাতারকা।</p> <p>সাকিব তখনো মহাতারকা হননি। তবে ২০০৮ সালে প্রায় একার হাতে নিউজিল্যান্ড সিরিজ জেতানোর মধ্য দিয়েই তাঁর স্টারডোমে মহাসমারোহে পদার্পণ। তখনো স্মিত হাসির মৃদুভাষী সাকিব। তাঁর ঘনিষ্ঠ একজনের কাছে শোনা,‘ও অনেক দূরে কেন যাবে জানেন? ওর ধ্যানজ্ঞান পারফরম্যান্সে। কারণ ও জানে, ভালো খেললে টাকা ওর পেছনে ছুটবে।’ সেই দর্শন মেনে সাকিব একের পর এক নৈপুণ্যের হার্ডল পেরিয়েছেন, অর্থও উদ্বাহু ছুটেছে তাঁর পেছনে।<br />  <br /> আমার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারের অনেকটা সময় ততদিনে পেরিয়ে এসেছি। খ্যাতির জগতের কিছু অন্ধকারও দেখা হয়ে গেছে। তাই আশঙ্কা হতো, এত তরুণ বয়সে খ্যাতির জৌলুষে না পা পিছলে পড়েন সাকিব। কোন এক অলস দুপুরে বিসিবির এক কর্মকর্তার কক্ষে ঢুকে দেখি সাকিবের সঙ্গে তামিম ইকবালও বসে। টুকটাক কথাচ্ছলে আমার মূল কৌতুহল ছিল একটা প্রশ্নের উত্তর জানা- বড় তারকা নাকি ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখতে চাও? আনঅফিসিয়াল কথাবার্তা, তাই ‘তুমি’ করেই সম্বোধণ করেছিলাম। সদ্য তারুণ্যে পা রাখা দুজনেই ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন। বর্হিবিশ্বে সুনাম করে ফেলা বাংলাদেশের দুই তারকা ভালো মানুষ হওয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন জেনে যে কেউই আশ্বস্ত হবেন। আমি বহুগুণ আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম।</p> <p>সময় যায়, সাকিব আরো বড় তারকা হয়ে ওঠেন, ফুলে ফেঁপে ওঠে তাঁর অ্যাকাউন্টও। সম্ভবত এতেও তাঁর মন ভরেনি। বল্গাহীনভাবে নিজের ইমেজ বিক্রি শুরু করেন তিনি। তারকাদের ইমেজ বিক্রিতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সেই বিক্রি-বাট্টা যদি তস্করদের সঙ্গে হয়, তবে বিশাল সমস্যা। শেয়ার কেলেঙ্কারি সর্বশেষ সেরকমই একটি সমস্যা। শেয়ার বাজারে অনিয়মের কারণে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন সাকিবকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। এই অর্থদন্ডের পক্ষে সাকিব অভাবিত এক যুক্তি দিয়েছেন। অনিয়ম নাকি তিনি করেননি, তাঁর নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ করেছেন।</p> <p>দাবিটা অযৌক্তিক। শেয়ার বাজারে সাকিবের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের আদ্যোপান্ত জানি। জানি বলেই বলছি যে, সাকিবের ব্যাখ্যা সত্যি। তিনি সরাসরি অনিয়ম করেননি বটে, তবে নিজের নাম ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যকে অনিয়মের পথ করে দিয়েছেন তিনি। ‘স্মার্ট’ সাকিবের কুশলী ‘মুভ’ এটা। যথাযথ কর্তৃপক্ষ ঘাঁটাঘাটি করলে আরও অনিয়ম খুঁজে পেলেও পেতে পারে।</p> <p>শুধু শেয়ার বাজার কেন, তাঁর প্রথম ব্যবসা ‘সাকিবস ডাইন’-এর গল্পটাও একই। ঠিক কবে, মনে নেই। বনানীতে জমকালো রেস্টুরেন্ট চালু করছেন সাকিব। কালের কণ্ঠে’র সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না। তবু নিমন্ত্রণ এলো। আমিও গেলাম গাঁটের টাকায় একটা কেক নিয়ে। কিছুদিন আগেই মুম্বাইয়ে টেন্ডুলকারের রেস্টুরেন্টে ডিনার করেছি। এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা রেস্টুরেস্ট ব্যবসা শুরু করছেন, গর্বের ব্যাপার। তো, সাকিব খুশি, তাঁকে ঘিরে থাকা আমরা মিডিয়াকর্মীরাও খুশি। কিন্তু কিছুদিন পর দেশের নামী এক জুয়েলারি ব্যবসায়ীর পুত্র মহা বিতর্কিত এক কান্ড ঘটালেন। তারপর শুনি, সাকিব’স ডাইনের মূল বিনিয়োগকারী নাকি তিনি! সেটি আর নেই।</p> <p>ওই প্রথম জানতে পারি, সাকিব শুধু নিজের নাম ব্যবহারের অনুমতি দেন। বিনিয়োগের ঝুঁকিতে তিনি যান না। সাতক্ষীরার কাঁকড়া ব্যবসা, মিরপুরে আরেকটি রেস্টুরেন্ট কিংবা বেসরকারী একটি ব্যাঙ্কের মালিকানা কেনার চেষ্টা- এর সবকটিতেই নিজের ইমেজ বিক্রি করেছেন বা চেষ্টা করেছেন সাকিব। চেষ্টা করেছেন মানে, ব্যাঙ্কটির অনুমোদন শেষ মূহূর্তে আটকে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে জুটি বেঁধে ব্যাঙ্কের জন্য আবেদন করেছিলেন সাকিব। কিন্তু সেই প্রবাসী হুন্ডি ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। ওদিকে ততদিনের সাকিবের ‘কৌশল’ অনেকটা আঁচ করে থাকবে সরকার। তাই ব্যাঙ্কের অনুমোদন পেতে পেতেও পাওয়া হয়নি সাকিবের। ব্যবসা জগতে তাঁর ট্র্যাক রেকর্ড বলছে, ব্যাঙ্কে মোটেও বিনিয়োগ করতেন না তিনি। নিজের ইমেজ বিক্রি করে থোক নিতেন, শুধু নামটা থেকে যেত। যেমন থেকে গেছে শেয়ার বাজারে। অপারেট করেছেন অন্য একজন। ব্যাঙ্ক অনুমোদনের বিনিময়েও সম্ভবত এককালীন নিয়ে অপারেশনে থাকতেন না সাকিব। আর আমানতকারী সর্বশান্ত হলে দায় এড়িয়ে যেতেন শেয়ার কেলেঙ্কারির মত।</p> <p>আসলে ঠিক মেলানো যায় না সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোর সাকিবের সঙ্গে ক্রিকেট মাঠে সাফল্যের শিখরে ওঠা সাকিব আল হাসানকে। ক্রিকেটই যাঁর ধ্যান-জ্ঞান, তিনি কিনা দীপক আগরওয়ালের মত জুয়াড়ির সঙ্গে জেনেবুঝেও দেড় বছর যোগাযোগ রক্ষা করেছেন! আইসিসির নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ক্রিকেটে ফেরার পর খবর বেরোয়, ভারতে একটি বেটিং সাইট পরিচালনায় যুক্ত তাঁর এক নিকটাত্মীয়! সাকিব অস্বীকার করেছেন। জনতাও মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত কিছু ‘কিন্তু’ নাকি বাজারে ‘আসি’ ‘আসবে’ করছে!</p> <p>সমস্যাটা এখানে। আর্ন্তজাতিক খ্যাতির জগতে পা ফেলা মাগুরার সহজ সরল সদ্য কৈশরোত্তীর্ণ সাকিবের পদস্খলনের পেছনে এই ‘মাননীয়র সব মেনে নেওয়া’ মানসিকতারও দায় আছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাকিবের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে, যার সারবেত্তা নিয়ে সংশয় আছে। ক্রিকেটাররা কণ্ঠ ছেড়েছেন সাকিবের পক্ষে। সোচ্চার জনতার মিছিলের আওয়াজ মিডিয়ায় শোনার পর বর্তমান সরকারও সাকিবের হত্যা মামলার ব্যাপারে সম্ভবত কিছুটা সহনশীল। এটা তবু যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু ২০১৯ বিশ্বকাপের পর জুয়াড়ি সংশ্লিষ্টতার কারণে আইসিসি সাকিবকে নিষিদ্ধ করার পর যেভাবে ওটাকে চক্রান্ত বলে ভক্তদের যে শোর উঠেছিল, তা অবান্তর। সাকিব দোষ করেছিলেন। বরং তিনি বুদ্ধিমান বলে আইসিসির দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দায় স্বীকার করেছিলেন। নয়ত, অন্তত পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তেন।</p> <p>তবু এন্তার গালমন্দ সয়েছেন তৎকালীন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান। না সয়ে উপায়ও ছিল না। ততদিনে সাকিব রাষ্ট্রের একটি মূল্যবান ‘টুলকিট’ হয়ে উঠেছেন। ২০২৪ জাতীয় নির্বাচনে সাকিবের আওয়ামী লীগের টিকিট পাওয়াও সে কারণে। যতদূর জানি, সেই ব্যাঙ্কের অনুমোদন না পাওয়ার পর মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে সাকিবের ঘনিষ্ঠতা তৎকালীন সরকার সুনজরে দেখেনি। প্রধানমন্ত্রী ফোন ধরতেন না, তাঁর কার্যালয়ের দরজাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সাকিবের জন্য। অতপর গত জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ‘এবি পার্টি’ থেকে ফরম নিয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু শেষমেষ টিকিট দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তৎকালীন সরকারী দলের মত পরিবর্তনের বোধগম্য কারণ একটাই হতে পারে- একতরফা নির্বাচনে সাকিবকে দিয়ে আর্ন্তজাতিকতার সিলমোহর দেওয়া। যেমনটা, ২০১৮ নির্বাচন রাজনীতির মাঠে টেনে এনেছিল মাশরাফি বিন মর্তুজাকে।</p> <p>এ যাবতকালে এই একটি ‘খেলা’ই সম্ভবত ভুল খেলেছেন সাকিব আল হাসান। গত নির্বাচনে অংশ না নিলে দেশে ফেরার জন্য এখন রাষ্ট্রের বিশেষ আশ্বাস চাইতে হতো না তাঁকে। শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি এবং আর সব আর্থিক অনিয়ম ধামাচাপা পড়ে যেত সাকিবের খ্যাতির দ্যূতিতে। ভক্ত থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যম হাততালি দিতেই থাকত।</p> <p>এটুকু পড়ে মনে হতে পারে পুরোটাই সাকিবের প্রতি বিদ্বেষ থেকে লেখা। কিন্তু মোটেও তা না। ক্রিকেটার সাকিবের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা আছে এবং থাকবেও। কিন্তু অর্থের পেছনে অন্ধের মত ছুটতে গিয়ে হোঁচট খাওয়া সাকিব মোটেও সমর্থণযোগ্য নন। কারণ, হোঁচট খেলেও তাঁর লাভ হয়েছে। চোট পেয়েছেন অনেক শেয়ার বাজার ও কাকড়া ফার্মের বিনিয়োগকারী। এসবের সঙ্গে ক্রিকেটার সাকিবের কোন যোগসূত্র নেই। কিন্তু ‘ব্যবসায়ী’ সাকিব এসবের দায় এড়াবেন কী করে? তাঁর এই পরিচয়কে অবধারিত ‘রেড ফ্ল্যাগ’! </p>