<p>ক্ষমতা হারানোর পর আওয়ামী লীগ আমলের দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের খবর বের হচ্ছে একে একে। শুধু মন্ত্রী আর এমপিই নন, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা আমলা, পুলিশ, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, ছাত্রনেতা, ব্যবসায়ীসহ কমবেশি সব শ্রেণি-পেশার মানুষই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিলেন। এই রকম বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির কর ফাঁকি এবং মুদ্রাপাচারের তদন্ত শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। সন্দেহে থাকা প্রভাবশালী ২২ জনের নামের তালিকা কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।</p> <p>তালিকায় আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শামীম ওসমান, নাজমুল হাসান পাপনসহ আরো অনেকেই রয়েছেন। এসব ব্যক্তির অবৈধ আয় ও কর ফাঁকি ধরতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কর গোয়েন্দাদের। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।</p> <p>তালিকার ব্যক্তিরা হলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, শেখ পরিবারের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, দুই ভাই শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান, সিরাজগঞ্জের এমপি শফিকুল ইসলাম এবং কিশোরগঞ্জের এমপি ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।</p> <p>তালিকায় আরো আছেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র, পরিবহন শ্রমিক নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা, পরিবহন নেতা ও এনা পরিবহনের মালিক কাজী এনায়েত উল্লাহ, দুদকের দুই প্রসিকিউটর খুরশীদ আলম ও মোশারফ হোসেন কাজল এবং ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি লিয়াকত শিকদার।</p> <p>সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ব্যবসায়ী জান্নাত আরা হেনরী, বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের দুই পুত্র আসাদুল আলম মাহির ও আশরাফুল আলম আছেন এই তালিকায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক দুই প্রধান প্রকৌশলীও আছেন এই তালিকায়। তাঁরা হলেন আশিকুর রহমান ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন।</p> <p>প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান ছাড়াও দুজন প্রভাবশালী সাংবাদিক শ্যামল দত্ত ও মনজুরুল আহসান বুলবুলের নামও রয়েছে তালিকায়।</p> <p>জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতিগ্রস্ত শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির অনিয়মের তদন্তে একযোগে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি, এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এবং বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ মুহূর্তে সংস্থাগুলোর টেবিলে অন্তত ৫০০ ব্যক্তির ফাইল রয়েছে।</p> <p>এনবিআর সূত্রে আরো জানা গেছে, এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিপুল কর ফাঁকি ও অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের নামে জমি, বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ স্থাবর সব সম্পত্তির আয়কর নথি এবং তাঁদের বাস্তব সম্পত্তির সরেজমিন তদন্ত করা হবে।</p> <p>সেখানে কোনো ধরনের অসংগতি পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্তদের স্থাবর সম্পদের খোঁজে এবার বিশেষ জোর দেওয়া হবে। আয়কর নথিতে দেওয়া সম্পদ বিবরণী কতটা সঠিক তা যাচাই করা হবে।</p> <p>২০০৭ সালে ১/১১-এর সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের আমলে সিআইসির ব্যাপক তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। তখন আতঙ্কে দুর্নীতিবাজদের অনেকেই রাস্তায় গাড়ি ও টাকার ব্যাগ ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সে সময়েও সিআইসি সরেজমিনে কোনো তদন্ত করেনি। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়েছিল।</p> <p>জানা গেছে, গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এনবিআরের কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের পৃথক গোয়েন্দা ইউনিট থাকলেও আয়কর অনুবিভাগের কোনো গোয়েন্দা ইউনিট ছিল না। সর্বশেষ গোয়েন্দা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট চালু করে এনবিআর। এ ছাড়া এনবিআরের তিনটি অনুবিভাগের সমন্বিত গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে সিআইসি।</p> <p>অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের অনুমোদন পাওয়ার পর এখন অনুসন্ধান চালাবেন আয়কর গোয়েন্দা। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সিআইসি ও আয়কর গোয়েন্দার কাছে এই মুহূর্তে প্রায় দেড় শ ব্যক্তির তালিকা রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিয়তই তালিকা করা হচ্ছে। একটি তালিকা বা দুটি তালিকাই চূড়ান্ত নয়। তালিকায় দেখা গেছে এমন অনেকের নাম বাদ পড়তে পারে। এটা একটা নিয়মিত প্রক্রিয়া।</p> <p>নাম প্রকাশ না করার শর্তে আয়কর গোয়েন্দার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যে নামের তালিকা এসেছে তাদের নিয়ে কাজ শুরু করা হবে। আয়কর গোয়েন্দার কাজের ধরন অনেকটা সিআইসির মতোই হবে। তারা তিনটি ইউনিট নিয়ে কাজ করে, আমরা শুধু আয়কর ফাঁকি নিয়ে কাজ করব।’</p> <p>এর আগে বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের দুই ছেলেকে ৫০০ কোটি টাকার অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করতে অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার সঙ্গে তৎকালীন কর কমিশনার সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদসহ ছয়জন কর কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন আয়কর গোয়েন্দা। সংস্থাটির কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুর রকিবের তৈরি সেই প্রতিবেদনের আলোকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল তিনজন কর্মকর্তাকে।</p> <p>কর ফাঁকির তদন্তে তোড়জোড় শুরু হলেও এই নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত আসলে ধরার জন্য করে নাকি সময় কাটানোর জন্য করে; উদ্দেশ্য কী? সেটা বোঝা মুশকিল। তদন্ত করে করে এ দেশে বহু সময় পার হয়ে গেল। খালেদা জিয়ার আমল গেল, মঈনের আমল গেল, হাসিনার এত বছর গেল; তদন্ত করে ধরতে না পারলে কী তদন্ত এগুলো? একসময় খালেদা জিয়া তাঁর সুবিধাজনকভাবে কাজ করাত। খালেদা জিয়া চলে গেল। হাসিনা তার সুবিধা অনুযায়ী হাসিনাগিরি করেছে। এখন প্রফেসর সাহেব (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) আসছেন, উনি তাঁর সুবিধা অনুযায়ী প্রফেসরগিরি করবেন। সময় বদলে গেলে তদন্ত ওভাবেই হবে।’</p> <p>এনবিআরের সাবেক সদস্য ও সিআইসির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ আমিনুল করিম কলের কণ্ঠকে বলেন, ‘আয়কর গোয়েন্দা এখন যে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকি প্রমাণিত হলে কেস রিওপেন হবে। রিওপেন হয়ে আবার নতুন করে নোটিশ দিয়ে তার ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে নতুন করে কর আরোপ হবে, জরিমানা হবে। তথ্য গোপন ও আয় গোপনের জন্য জেলের বিধানও আছে। সে ব্যবস্থাও এনবিআর নিতে পারে।’</p> <p>ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পটপরিবর্তনের আগে এনবিআরসহ অন্যান্য সংস্থা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যারা উচ্চ করদাতা তারা যে কর ফাঁকির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেছে, অন্যায় করেছে, অপরাধ করেছে, সে জন্য তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানসহ যারা বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে তাদের ফাইল পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে তারা কিসের বিনিময়ে এই বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে।’</p> <p>তালিকায় থাকা সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে টাকা লুটপাট, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলদারিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। দুই সিটির প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলদারি, সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন মার্কেট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল ছাড়াও নগর ভবনের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। দুদকের দুই প্রসিকিউটরের বিরুদ্ধেই রয়েছে দুর্নীতির তদন্তে হস্তক্ষেপ এবং অর্থের বিনিময়ে রফাদফা করার ভয়াবহ অভিযোগ। এস আলমের দুই ছেলে আসাদুল আলম মাহির ও আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে কর ফাঁকি, ব্যাংক দখল ও অর্থপাচারের অভিযোগ আছে।</p> <p>সাদামাটা গৃহবধূ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদে সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ বাগিয়ে নিয়ে আলাদিনের প্রদীপের মতো ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় জান্নাত আরা হেনরীর। মাত্র তিন বছরেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যান। এরপর দলীয় পদ-পদবির পাশপাশি বাড়তে থাকে সম্পদের পরিধিও। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর নিজের স্বামীকেও বানান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। হলমার্কের চার হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম আসে সবার আগে।</p> <p>পরিবহন নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা ও কাজী এনায়েত উল্লাহ ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবহন খাতের ভ্যানগার্ড। কারণে-অকারণে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাড়িয়েছেন বাসের ভাড়া। ঘাটে ঘাটে খুলে বসেছিলেন চাঁদাবাজির দোকান। গত ১৫ বছরে শুধু এনায়েতের পেটেই গেছে ১১ হাজার কোটি টাকা। সাংবাদিকতার আড়ালে সরকারের তোষামোদি করে বিভিন্ন সুবিধা ও পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন নাঈমুল ইসলাম খান, শ্যামল দত্ত ও মনজুরুল আহসান বুলবুল।</p> <p>সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী ছিলেন পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। দুই দফা বাড়ানো হয় তাঁর চাকরির মেয়াদ। সম্পদের হিসাবে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন পুলিশের আরেক বিতর্কিত কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদকেও। সাবেক মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অন্তহীন অভিযোগ।</p>