<p style="text-align:justify">ডাহুকের ডাক শুনে কেউ বলত ‘ক্রোয়াক’, কেউ শুনত ‘ডুয়াক’; আর আমরা শুনতে পেতাম ‘ডউক’। পাখিটি আসলে কী বলে সেই তর্ক আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। পণ্ডিতরা বলেন, মানুষের সীমিত স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের চেয়ে পাখির স্বরের ব্যাপ্তি অনেক বেশি; তাই বিতর্কটি অমীমাংসিত থাকতে বাধ্য। তবে ডাক থেকেই এই পাখির বাংলা নামটি যে ‘ডাহুক’ হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।</p> <p style="text-align:justify">শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে বলতে পারি যে আশ্বিন মাসেই আমাদের গ্রামে ডাকাডাকি শুরু করত ডাহুক পাখি। সকালে ও সন্ধ্যায় জোরগলায় ওরা ডাকত : ‘ক্রোয়াক ক্রোয়াক...’ অথবা ‘ডুয়াক ডুয়াক...’ কিংবা ‘ডউক ডউক...’। চাঁদনি রাতে প্রায়ই ডাহুক সরব থাকত বলে অনিদ্রা রোগে আক্রান্ত প্রবীণরা অভিযোগ করতেন নিরবচ্ছিন্ন সেই ডাকাডাকির বিরুদ্ধে। তবে ডাহুকের ডাকাডাকির সঙ্গে প্যাঁচার ‘নিম নিম’ ডাকের মতো অমঙ্গলের কোনো যোগসূত্র তাঁরা স্থাপন করেননি বলে আমরা কৃতার্থ ছিলাম। আমাদের কাছে গাঁয়ের ডাহুক পাখি ছিল অত্যন্ত প্রিয় ও আদরের জীব।</p> <p style="text-align:justify">শিশুদের মতোই ওরা সাতেও নেই, পাঁচেও নেই; আপন মনে পানি-কাদায় ঘুরে বেড়াতে পারলেই ডাহুক খুশি। প্যাঁচার মতো ওরা যেমন পালিয়ে চলে না, তেমনি শালিকের মতো মানুষের সঙ্গে বেশি মাখামাখিও করে না। তুলার বলের মতো ছানাপোনা নিয়ে ওরা গ্রামের খানাডোবায় হেঁটে বেড়ায়। প্রতিটি পগার, মাইঠাল কিংবা তালপুকুর ছিল কোনো না কোনো ডাহুক পরিবারের দখলে।<br /> মানুষভেদে ডাহুকের ডাক কেন যে বিভিন্ন শোনায় তা ছিল আমাদের বোধগম্যের বাইরে। ডাহুকের ডাক শুনে কেউ বলত ‘ক্রোয়াক’, কেউ শুনত ‘ডুয়াক’; আর আমরা শুনতে পেতাম ‘ডউক’। পাখিটি আসলে কী বলে সেই তর্ক আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। পণ্ডিতরা বলেন, মানুষের সীমিত স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণের চেয়ে পাখির স্বরের ব্যাপ্তি অনেক বেশি; তাই বিতর্কটি অমীমাংসিত থাকতে বাধ্য। তবে ডাক থেকেই এ পাখির বাংলা নামটি যে ‘ডাহুক’ হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।</p> <p style="text-align:justify">ডাক থেকেই আরো অনেক পাখির বাংলা নাম দেওয়া হয়েছে; যেমন—ঘুঘু, কাক, কুরা, টিয়া, টুনটুনি, হটটিটি, মেঘহও, চোখ গ্যালো, বউ কথা কও, ফটিকজল ইত্যাদি। একইভাবে ডাক থেকেই ডাহুকের নাম আসামে ‘ডাউক’, ওড়িশায় ‘ডাহুকা’ এবং শ্রীলঙ্কায় ‘কোরাওয়াক্কা’ হয়েছে। ওদিকে তামিল ভাষায় ডাহুকের সুমধুর নাম ‘কানাংগাজি’ এবং কানাড়া ভাষায় তার অসাধারণ নাম ‘কুন্দুকলি’ কিন্তু ডাকের ভিত্তিতে হয়নি।            </p> <p style="text-align:justify">           <br /> সেকালে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেই ডাহুকের ডাকে ভোর হয়েছে প্রতিদিন। ডাহুকের সেই ডাকাডাকি আজ আর নেই। গ্রাম থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে গোষ্পদ, খানাডোবা ও পানাপুকুর। কিছু তার ভরাট করে আমরা বসতবাড়ি ও হাটবাজার করেছি। সাফসুতরা করে বাকিগুলোতে চলছে চিংড়ি ও মাছের চাষাবাদ। গ্রামে আছে শুধু মানুষ ও মানুষের আহার্য; ডাহুকের কোনো স্থান নেই। ফসলের ক্ষেতে আর ফলের বাগানে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছিটিয়ে আমরা ধ্বংস করেছি রাজ্যের যত পোকামাকড়, যা খেয়ে বেঁচে ছিল ডাহুকের পরিবার। আমাদের জন্য ফসলের ভুঁই, সবজির ক্ষেত, ফলের বাগান, মাছের খামার, যাতায়াতের পথ, বিকিকিনির স্থান, বিদ্যালয়, বিনোদনকেন্দ্র ইত্যাদি কত কিছু চাই! নির্মল বায়ু, শ্যামল ছায়া, পাখির কুজন না হলেও আমাদের চলবে বলেই আমরা মনে করি। তাই নীরবে বিদায় নিয়েছে গাঁয়ের সাদামাটা ডাহুক পাখি। বানের পানিতে টান ধরলে নদীনালার আঁকেবাঁকে আগ্রাসী কচুরিপানা এসে কিছুটা স্থান অগম্য করে রাখে বলে সেখানে আজও কিছু ডাহুক টিকে আছে। নইলে ডাহুকের ডাক শুনতে আমাদের যেতে হতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য কোনো দেশে। </p>