<p>সৃষ্টিজগতে মানুষের মেধা, সৃষ্টিশীলতা আর ‘অসীম’ ক্ষমতা তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। যখন মিসরের পিরামিডের দিকে তাকাই, তখন বিস্মিত হতে হয়। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মরুভূমির বুকে এমন বিশাল পিরামিড কী করে বানাল প্রাচীন মিসরীয়রা! স্থাপত্যকলার এমন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান কেমন করে পেয়েছিল! কেমন করে গাণিতিক আর জ্যামিতিক হিসাব-নিকাশ সুদক্ষভাবে সম্পন্ন করে বানিয়েছিল পিরামিড, যা হাজার হাজার বছর পরেও সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে!</p> <p>১৯৮২ সালে তখন আমি এমএ ক্লাসের ছাত্র। প্রথমবারের মতো গিয়েছিলাম আগ্রায় তাজমহল দেখতে। ওপরে উঠে সমাধির ওপর চোখ পড়ল। লাল-সবুজ নানা রঙের ফুলের নকশাকাটা। ফুল, পাতা এত ঝলমল করছিল, মনে হচ্ছিল এই মাত্র বোধ হয় সংস্কার করেছে। টাটকা রং হাতে লেগে যাবে।একবার আঙুলে ছোঁয়া লাগিয়ে দিলাম। না, হাতে তো রং লাগল না! ভুল ভাঙল আমার। এ তো রং নয়, রঙিন পাথর কেটে মিনা করা হয়েছে। ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে এমনই জ্বলজ্বল করছে। তখনো বিস্মিত হয়েছিলাম মানুষের প্রতিভার কথা ভেবে।</p> <p>আধুনিক যুগে তো মানুষ বিস্ময়কর প্রতিভার প্রকাশ দেখাচ্ছে। পারমাণবিক অস্ত্রসহ নানা ভয়ংকর মারণাস্ত্র বানাচ্ছে। তা দিয়ে ক্ষমতাবানরা জীবন ও সভ্যতা সংহার করছে। বিশ্বের নানা দেশের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। মহাকাশযান আর আধুনিক যন্ত্রকৌশলে মহাকাশে মানুষের বিকল্প বসতি খুঁজে বেড়াচ্ছে।</p> <p>আমরা মহামারির মতো মহাবিপর্যয়ে পড়লে কিছু সময়ের জন্য হলেও থমকে যাই। মানুষের শক্তিকে ভীষণ সীমাবদ্ধ মনে হয়। দাপুটে দেশের শক্তিমানরাও কেমন চুপসে যায়। কণ্ঠের দৃঢ়তা হারিয়ে যায়। এখন ইসরায়েলি বিমান গাজা ও সিরিয়ায় বোমা ফেলছে। বিশ্বজুড়ে সমালোচনা নেতানিয়াহুদের ছুঁয়ে যায় না। অকাতরে জীবন সংহার করছে। কিন্তু করোনার মতো মহামারি হলে কোনো কূটনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই এই শক্তিমানরা নিশ্চুপ হয়ে যেত। তাদের অসহায়ত্ব স্পষ্ট হতো।</p> <p>মানুষের ক্ষমতা আবিষ্কার করা কঠিনমানুষের যুগের আগেও কত সরীসৃপের যুগ লাখ লাখ বছর অতিক্রম করেছে। তারপর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কোনোভাবেও আটকানো যায়নি। মানুষের সাক্ষাৎ পূর্বসূরি প্রাইমেটরাও লাখ বছর চষে বেড়িয়েছে পৃথিবী। তারপর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। একই ধারাবাহিকতায় প্রাকৃতিক দুর্বিপাক মানুষ আর মানবসভ্যতাকে যদি ধ্বংস করে দিতে চায়, তবে কী অস্ত্র আছে মানুষের যে তা রোধ করবে!</p> <p>অনেক সময় শক্তির দম্ভে মানুষ মানতে চায় না তার চেয়ে বড় স্রষ্টা আর কেউ আছে। কিন্তু বিপদে বিপন্ন অবস্থায় পৌঁছে গেলে প্রকৃতি বলি আর আস্তিক মানুষের ধর্মীয় দৃষ্টিতে ঈশ্বরই বলি—এর শক্তির কাছে মানুষের ক্ষমতা ক্ষুদ্র বালুকণার মতোই মনে হবে। কী এমন করোনাভাইরাস—ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। অনুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া চোখে পড়ে না। এর কী ক্ষমতা! চীন থেকে যাত্রা শুরু করে হাজার হাজার কিলোমিটার মুহূর্তে অতিক্রম করে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল মানুষের দেহে। এই আক্রমণ রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ল পৃথিবীর তাবৎ শক্তিমান বিজ্ঞানীদের পক্ষে। ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হওয়ায় নিয়ন্ত্রণে আসে করোনাভাইরাস।</p> <p>তবে মানষের অদ্ভুত আচরণ এমন যে বরাবরের মতো এই কষ্টের স্মৃতি ভুলে যাবে। দম্ভ দেখিয়ে আবার মানবতার কণ্ঠনালি চেপে ধরবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজ ঐতিহ্য এবং বঙ্গবন্ধুর মহান আত্মত্যাগ ভুলে ক্ষমতান্ধ হয়ে যান। দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে বসেন। এভাবে অন্যায়ের ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ায় রুষ্ট হয়েছিল চারপাশ। তিনি এবং তাঁর তোষামোদকারীরা তা বুঝতে চাননি। অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-জনতার বিপ্লবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেল সব। দাম্ভিকরা চুপসে গেলেন।</p> <p>করোনাভাইরাসের আতঙ্কিত সময়ে ফেসবুকে দুজনের পোস্ট আমার দৃষ্টি কেড়েছে। একটির লেখক কোনো এক কন্যা। তাঁর পোস্ট পড়ে জানলাম তিনি একজন লেখক। আর বুঝলাম তিনি ঈশ্বর-ধর্মে তেমন আস্থাশীল নন। এটি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। তবে এ দেশের অনেক প্রগতিবাদীর যে কমন সংকট, তা এই লেখিকার মধ্যেও আছে। তিনি আস্তিক বলতে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসীদের বোঝাতে চেয়েছেন। এন্তার সমালোচনা করেছেন তাদের। আরেকটি অডিওতে কণ্ঠ দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন একজন তরুণ (কণ্ঠ শুনে মনে হলো)। বক্তব্য শুনে ধারণা হলো, তিনি জঙ্গি সমর্থক কেউ হবেন। তিনি ছবিসহ বাংলাদেশের বরেণ্য ১০ জন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সবাইকে পরিচিত করিয়েছেন। তাঁর ভাষায় তাঁরা সবাই নাস্তিক। প্রমাণ হিসেবে তাঁদের দু-একটি বক্তব্যও তুলে ধরেছেন। বিষোদগারও করেছেন।</p> <p>আমি বুঝলাম না কে আস্তিক আর কে নাস্তিক, এই খোঁজ তাঁকে কে রাখতে বলেছে! কে ঈশ্বরে বিশ্বাসী আর কে বিশ্বাসী নন, এসব তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়। যে ধর্মে তরুণটি বিশ্বাসী, সে ধর্ম কি তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছে এসব তদারকির? কথায় মনে হলো তিনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। মুশকিল হলো, যাঁরা ধর্মে বিশ্বাসী নন আর যাঁরা অতিবিশ্বাসী, তাঁদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষ থাকেন, যাঁরা নিজেদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে বিষবাষ্প ছড়ান। মানবতার বড় ক্ষতি করেন। কয়েকজন প্রাজ্ঞ মানুষকে নাস্তিক বলে যিনি জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে চাইছেন, আমি জানি না নিজ ধর্ম সম্পর্কে তাঁর চর্চা কতটুকু আছে। আবার যাঁরা ধর্মকে তুচ্ছ করে দেখছেন, প্রগতিবিরোধী ভাবছেন, তারা কতটা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব চর্চা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তা এক বড় প্রশ্ন।</p> <p>আমাদের দেশের একজন প্রতিথযশা চিত্রশিল্পী এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক একবার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘দেখুন, প্রকৃতি বলুন আর ঈশ্বর বলুন, তাঁর ক্ষমতার কাছে আমরা শিশু। আমি একজন চিত্রশিল্পী হিসেবেই বলছি, আমাদের ক্ষমতা নেই এমন সুনিপুণ এবং ভারসাম্যমূলক রঙের ব্যবহার করা। আপনি সমুদ্র আর নদীর বিচিত্র রঙের মাছ, নানা জাতের পাখির পালক, ডানা, পা, ঠোঁটের রং গভীর মনোযোগে দেখুন, এত বিচিত্র রঙের ব্যবহার, পরিমিতি বোধ, ভারসাম্য মানবজগতের কোনো শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয়।’</p> <p>আজ বিশ্বের তাবড় তাবড় শক্তিশালী দেশ কয়েক দিন আগেও করোনাভাইরাসের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়েছিল। তারা গাজা-ইসরায়েল আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ থামাতে পারছে না। এতে বোঝা যায় মানবজগতের পাণ্ডা হয়ে যতই দম্ভ প্রকাশ করি না কেন, আসলে মানুষের ক্ষমতা বড়ই সীমাবদ্ধ। আবার এই মানুষই অসাধ্য সাধন করেছে বারবার।</p> <p>সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠায় সবাই দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে বড়ই দাপটে চলেছে এ দেশে। নিজ দলের বাইরে কাউকে পরোয়া করতে চায়নি তারা। এই দাপুটে সরকারের সামনেই বিনা মেঘে যেন বজ্রপাতের মতো ছাত্র-জনতার বিপ্লব সব দাম্ভিককে ভাসিয়ে দিল।</p> <p>এখন নানা দিক থেকে সমালোচনা চলছে এই রক্তমূল্যে প্রাথমিক সাফল্য লাভ করা বিপ্লবের অন্তর্গত ইচ্ছার কতটুকু পরিবর্তন সাধন সম্ভব! বরাবরই জেনে আসছি, সামনে এগিয়ে যেতে হলে অতীতকে মূল্যায়ন করতে হবে। এ জন্য বলা হয় ইতিহাস জীবন্ত জাতির পরিচায়ক। কিন্তু আমরা যখন বিপ্লবোত্তর স্পর্শকাতর সময়ে অধিক দায়িত্বশীলতার সঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করব, তখন যদি ইতিহাসকে অস্বীকার করি বলি বাটন টিপে অতীতকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বর্তমানকে নিয়ে এগিয়ে যাব, তখন তো ভয়ংকর বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এ তো এক ধরনের অন্ধত্ব। ফলে সামনের গভীর খাদ চোখে পড়বে না। গর্তে হারিয়ে যাওয়ার পরিণতিই মেনে নিতে হবে।</p> <p>একাত্তরকে বুঝতে হলে ১৯৪৭ থেকে সব আন্দোলন-সংগ্রামকে বুঝতে হয়। ১৯৪৭-এর বাস্তবতা বুঝতে হলে অন্তত ঔপনিবেশিক যুগের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে হয়। একাত্তর না বুঝে ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবকে কেমন করে মূল্যায়ন করব! মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও চেতনা কিভাবে নিজ দলে আটকে রেখে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল বিগত সরকার, গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে কিভাবে কার্যত একনায়কত্ব চাপিয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, তা বুঝতে না পারলে এবারের গৌরবোজ্জ্বল বিপ্লবকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, জাতি ও বিশ্ব বুঝবে কেমন করে!</p> <p>বিপ্লবোত্তর এই ভাবনাগুলো আমরা কি ভাবতে পারছি! আদর্শিক বিভেদ রাজনীতিতে থাকবেই। যার যার লক্ষ্য পূরণে দেশি-বিদেশি মদদও থাকবে। কিন্তু মানতে হবে এসব শক্তিই বড় শক্তি নয়, মানুষ তার শক্তির সীমাবদ্ধতা সময়ের ডাকে অতিক্রম করতে জানে। প্রকৃতি তখন আত্মশক্তিতে বলীয়ান মানুষের পাশে দাঁড়ায়। প্রণোদনা কখন কোথা থেকে মানুষের ভেতর শক্তি জোগাবে, তা কে বলতে পারে! মানুষ নিজেই কি জানে তার ক্ষমতা কতটা অসীম?</p> <p><em>লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়</em></p> <p><em>shahnawaz7b@gmail.com</em></p>