<p>অবিভক্ত ঢাকা জেলার বারদি গ্রামে ছিল জ্যোতি বসুর পরিবারের আদি বাসস্থান। জ্যোতিবাবুর জন্ম যদিও কলকাতায়, কিন্তু বাঙালি আর বাংলাদেশ ঘিরে আজন্ম একটা আবেগ বুকের গহিনে তিনি লালন করে গিয়েছিলেন। ‘আবেগ’ শব্দটি ব্যবহার করা হলো, এতে হয়তো অনেকে বলবেন : জ্যোতিবাবুর মধ্যে লোকচক্ষুর সামনে আবেগের প্রকাশ খুব একটা ছিল না। এই কথাটি তাঁর সম্পর্কে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হলেও এটা বলতে হয়, যখনই বাংলাদেশের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে কৃতী মানুষ তাঁর কাছে গেছেন, তা তিনি রাজনীতির জগতেরই হন বা সাহিত্য-সংস্কৃতির দুনিয়ারই হোন, তাঁদের প্রতি একটা অন্য ধরনের আন্তরিক টান জ্যোতি বাবু অনুভব করতেন।</p> <p><img alt="জ্যোতি বসু " height="427" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/Harun/2024/July-2024/08-07-2024/Jyoti Bose-01_kalerkantho_pic.jpg" style="float:left" width="400" />অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির যে রাজনৈতিক অবস্থান ছিল, সেই অবস্থান অনুযায়ী দেশভাগের সময়কালে, অবিভক্ত বাংলার আইনসভায় কমিউনিস্ট পার্টি দেশভাগের পক্ষেই অভিমত ব্যক্ত করেছিল। পার্টিগত প্রাণ জ্যোতিবাবু সেই অবস্থানের প্রকাশ্যে কোনো দিন কোনো রকম বিরোধিতা করেননি। কিন্তু যাঁরা তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, জানার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁদের কিন্তু এটা সব সময় মনে হয়েছিল : ‘বাঙালি’ এই শব্দটি কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থানে আটকে রাখার পক্ষপাতী জ্যোতিবাবু কোনো দিন ছিলেন না। বৃহত্তর অর্থে বাঙালিকে সম্মান এবং মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে তিনি ছিলেন অকৃপণ।</p> <p>বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে একটা একাত্মতা জ্যোতিবাবু অনুভব করতেন। তিনি যখন রাজনীতির জগতে অত্যন্ত সক্রিয়, সেই সময় ইন্টারনেট ইত্যাদির কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক খবরাখবর পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের রেডিও, খবরের কাগজ, পরবর্তীকালে টেলিভিশনের ওপরই একমাত্র নির্ভর করে থাকতে হতো। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঘিরে সর্বশেষ খবর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার বিষয়ে ভারতের রাজনীতিকদের মধ্যে জ্যোতিবাবুর যে আগ্রহ ছিল, তেমনটা সমসাময়িককালে আর কোনো ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিল কিনা সন্দেহ।</p> <p>আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ভূগোল জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক জীবন বিস্তারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রেল শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে ,আজকের বাংলাদেশের লালমনিরহাট, জ্যোতিবাবুর জীবনে একটা বিশেষ রকমের অধ্যায় জুড়ে আছে।</p> <p>বিদেশে আইনবিদ্যা শিখে, সেখান থেকে কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, গোটা জীবন মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত করার সংকল্প নিয়ে জ্যোতিবাবু যখন অবিভক্ত ভারতে ফিরে আসেন, তখন তাঁকে প্রথম লড়তে হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ উৎখাত করার প্রশ্নে যে তিনটি প্রধান ধারা বেগবান ছিল; গান্ধীজীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ধারা, সশস্ত্র বিপ্লববাদের ধারা, আর কমিউনিস্টদের একটা সুনির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই- সেই প্রতিটি ধারার সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জ্যোতিবাবুর একটা সংযোগ ছিল।</p> <p>ব্রিটিশের প্রতি ঘৃণার  মনোভাব শৈশব কিশোরের দিন থেকেই মনের গহীনে জ্যোতিবাবু লালন-পালন করতেন। সেই কারণে নিজের জ্যাঠামশাই ব্রিটিশ পুলিশের জজ- এটা কিশোর জ্যোতি বসু মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। সে কিশোর বয়সেই জ্যোতিবাবুর বাস্তববোধের এক অনবদ্য ঘটনা, এই নিবন্ধকারকে শুনিয়েছিলেন তাঁর সম্পর্কিত পিসিমা ইন্দুসুধা ঘোষ।</p> <p>ইন্দুসুধা ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধারার একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ যখন তাঁকে কার্যত হত্যা করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে, তখন সেই কিশোরী ইন্দুসুধাকে নিজের শান্তিনিকেতনে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। সশস্ত্র বিপ্লববাদী ধারার প্রতি রবীন্দ্রনাথের কখনো এতটুকু দুর্বলতা ছিল না। তাই বলে সশস্ত্র বিপ্লববাদী ধারায়, ব্রিটিশকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে আন্দোলন করে যাঁরা ব্রিটিশের চক্ষুশূল হয়েছেন, তাঁদের প্রতি কিন্তু এতটুকুন বীতরাগ রবীন্দ্রনাথের ছিল না। তাই ইন্দুসুধাকে শান্তিনিকেতনে ছাত্রী হিসেবে ঠাঁই দিয়ে তাঁকে ব্রিটিশের রোষানল থেকে বাঁচিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।</p> <p>এই ইন্দুসুধা ঘোষের কাছে জ্যোতিবাবুর কৈশোর কালের একটি ঘটনা শোনার সুযোগ এই নিন্ধকারের ঘটেছিল। তাঁদের কলকাতার বাড়িতে একবার সবাই মিলে দুপুরে খেতে বসেছেন। পরিচারকদের অসতর্কতায় কোনোভাবে আহার্য কোনো বস্তুটিতে বাইরের কোনো পোকামাকড় পড়েছে। অনেকেরই সেটা চোখ এড়িয়ে গেছে ।কিন্তু কিশোর ‘গনা’র (জ্যোতিবাবুর ডাক নাম) সেটা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কিন্তু পাছে গোটা ঘটনাটি বললে কোনো না কোনো কারণে একান্নবর্তী পরিবারের সবারই খাওয়া মাথায় ওঠে, তাই তিনি অত্যন্ত মৃদু স্বরে, বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে, পরিচালককে সংশ্লিষ্ট খাবারের পাত্রটিকে সরিয়ে নিতে বললেন। পরবর্তী সময়ে খাওয়া-দাওয়ার পর তাঁর পিসীমা ইন্দুসুধাকে জ্যোতিবাবু বললেন, কি কারণে ওই খাবারটিকে তিনি সরিয়ে নিতে বলেছিলেন।</p> <p>এই বাস্তববোধের ওপর দাঁড়িয়েই জ্যোতিবাবুর গোটা রাজনৈতিক জীবন পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। জ্যোতিবাবু রাজনীতির বাইরে কখনো ব্যক্তিজীবন ঘিরে এতটুকু আগ্রহ প্রকাশ করতেন না। ব্যক্তি জীবনের পছন্দ-অপছন্দ কে ঘিরে তাঁর মধ্যে কখনো কোনো ধরনের মোহ ছিল না। সবটাকেই  তিনি দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন রাজনীতির নিক্তিতে মেপে।</p> <p>তাই যখন আজকের বাংলাদেশ, সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে, আইয়ুব, ইয়াহিয়ার নানা ধরনের আর্থিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আগ্রাসনের জালে আকীর্ণ, সেই সময় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিকে, পরবর্তীকালে তাঁর নিজের দল সিপিআই(এম)কে, পাকিস্তানের এই সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক শোষণ- এসব রাজনৈতিক বিষয়াবলি সম্পর্কে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় স্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।</p> <p>পাকিস্তান আমলে, বাংলাদেশের মানুষের ওপরে অত্যাচার, বিশেষ করে যখন রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো আইয়ুব খানের সামরিক জান্তার মাধ্যমে, এই যে ঘটনাক্রম তা জ্যোতি বাবুকে, ভারতীয় উপমহাদেশে, গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক কার্যক্রমকে সংকীর্ণ করে দেওয়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, এই আশঙ্কায় বিশেষভাবে বিষণ্ন করে তুলেছিল। </p> <p>অবিভক্ত পাকিস্তানের সময়কালে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যদি ভারতের কমিউনিস্টরা কখনো কোনো রকম রাজনৈতিক আন্দোলন করতেন, তাহলে সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হতো। জ্যোতি বাবু কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আমলে, সেখানকার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের যে আগ্রাসী মানসিকতা, তার বিরোধিতার প্রশ্নে, তার প্রতিবাদের প্রশ্নে এবং বাঙালিকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরামর্শ দেওয়ার প্রশ্নে কোনো দিন কোনো রকম আপসগামী মানসিকতা নিয়ে চলেননি।</p> <p>মুক্তিযুদ্ধের কালে সিপিআই(এম)ই হচ্ছে সেই রাজনৈতিক দল, যারা প্রথম ভারত সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার। মহান মুক্তিযুদ্ধকে সরকারিভাবে সমর্থন জানানোর। ভারত সরকার নানা ধরনের কূটনৈতিক কারণে প্রবাসী সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল থেকেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে কিছুটা সময়ক্ষেপণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতির জেরে সেই সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে, বিপুলসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে বাঙালি এপার বাংলায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের প্রতি যথার্থ ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে ভারত সরকারের ওপর চাপ তৈরির ক্ষেত্রে জন্য জ্যোতিবাবু যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।</p> <p>অপরপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের যে একটি বড় অংশ, প্রত্যক্ষভাবে যারা বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে লড়াই করছে, তাঁদের সাহায্যের উদ্দেশ্যেপশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায় চলে আসেন, তাঁদের সাহায্যের ব্যাপারে জ্যোতিবাবু নিজের রাজনৈতিক দলকে যেমন পরিচালিত করেছিলেন, ঠিক তেমনি নিজের সমস্ত ধরনের সমর্থন উজাড় করে দিয়েছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি।</p> <p>মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি অংশ আন্তর্জাতিক স্তরে পাকিস্তানি  হানাদারদের কুকীর্তি  তুলে ধরার ক্ষেত্রে কলকাতার বুকে বসে যে ধরনের কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন, সেগুলোর সাফল্য যাতে ঠিকভাবে আসে, সে ক্ষেত্রেও জ্যোতিবাবু ছিল ঐতিহাসিক ভূমিকা। জ্যোতিবাবু কখনোই নিজেকে বিজ্ঞাপিত করে কোনো মানুষের পাশে থাকার ঘটনাকে উপস্থাপিত করতেন না। এটা তাঁর গোটা রাজনৈতিক জীবনের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কালে তিনি যে দলে অবস্থান করেন, সেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত মানুষজন যাতে সার্বিকভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিধ্বস্ত করার জন্য সব রকম সাহায্য এপার বাংলার বাঙালির কাছ থেকে পায়, সেই প্রশ্নে জ্যোতিবাবুর ভূমিকা এবং অবদান ঐতিহাসিক।</p> <p>নিজের দলের বিশিষ্ট কৃষক নেতা সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ কলকাতার বাড়িকে কেন্দ্র করে জহির  রায়হানের যে কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে পাকিস্তানি হানাদারদের স্বরূপ তুলে ধরার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’, সেটি তৈরির জন্য যে যে ধরনের আর্থ- সামাজিক সহযোগিতা প্রয়োজন, সেগুলো সংঘটিত করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন জ্যোতি বসু।</p> <p>‘স্টপ জেনোসাইজ’ তথ্যচিত্রটি তৈরির সঙ্গে জহির রায়হানসহ আর যিনি খুব গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন, তিনি হলেন, বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। পরবর্তী সময়ে হাসান ইমামের সঙ্গে জ্যোতিবাবুর একটা গভীর প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে হাসান ইমামের আত্মীয়-পরিজন, নানা আবুল কাশেমের সঙ্গে জ্যোতিবাবুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। হবিবুল্লাহ বাহারের সঙ্গেও অবিভক্ত বাংলার আইনসভায় জ্যোতিবাবুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পরবর্তী সময়ে সেলিনা জামান বাহারকে নিয়ে এই নিবন্ধকার একাধিকবার জ্যোতিবাবুর কাছে গিয়েছিলেন। সেলিনা বাহারের সঙ্গে আলাপচারিতায় জ্যোতি বাবু, হবিবুল্লাহ বাহারসহ অবিভক্ত বাংলার আইনসভায়, তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধা পূর্ণভাবে বারবার স্মরণ করতেন।</p> <p>বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ছিল জ্যোতি বসুর অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে দুজনের চলার পথ ভিন্ন হলেও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে, দুজনের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার মধ্যে কোনো সংঘাত ছিল না। জ্যোতি বাবু যে মানুষের মুক্তির স্বার্থে একটা বৃহত্তর মানুষের ঐক্যের ভাবনায় চিরদিন বিশ্বাসী ছিলেন, সেই আঙ্গিক থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ করে পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, মুক্তিযুদ্ধকে একটা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনায় সার্বিকভাবে পরিচালিত করা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বাহাত্তরের মহান সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান হিসেবে উপস্থাপন করা- এ বিষয়গুলোর নিরিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি জ্যোতিবাবু ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধাশীল।</p> <p>যে সামরিক জান্তা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবিশ্বাসী রাজাকার আলবদর, আল-শামসদের সাহায্যে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল, তাদের প্রতি চিরদিন অন্তহীন ঘৃণা পোষণ করতেন জ্যোতিবাবু। বঙ্গবন্ধুর ওপর সাম্রাজ্যবাদের নেতিবাচক মানসিকতা প্রসঙ্গে জ্যোতিবাবু বারবার বলতেন, ফিদেল কাস্ত্রর বঙ্গবন্ধুকে বলা সেই ঐতিহাসিক কথাটি- আজ থেকে একটি বুলেট আপনার সঙ্গী হলো।</p> <p>পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগীরা যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রকে পরিচালিত করেছে, সেই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যদি কেউ কথা বলতেন, তাঁদের নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করত বাংলাদেশের তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সরকারগুলো।</p> <p>বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ যাতে অন্নদাশঙ্কর রায় না করেন, তার জন্য সেই সময়ের ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিত থেকে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। কোনো চাপের কাছেই অন্নদাশঙ্কর কিন্তু আত্মসমর্পণ করেননি। ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য একটি প্রবন্ধ লিখে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানান। প্রবন্ধটির নাম ছিল, ‘কাঁদো প্রিয় দেশ’। কিন্তু ভারতের সেই সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা নিরিখে সেন্সারশিপের জ্বালায় ‘দেশ’ পত্রিকাকে ওই প্রবন্ধটি ছাপতে দিতে চাননি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। সিদ্ধার্থ শংকরের যুক্তি ছিল, অন্নদাশঙ্করের এই প্রবন্ধটা দেশ পত্রিকার প্রকাশিত হলে নাকি হাজার হাজার উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে পড়বে।</p> <p>কোনো রকম রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধটির সঙ্গে আরো কয়েকটি প্রবন্ধ যুক্ত করে, সেই সময় ‘কাঁদো প্রিয় দেশ’ বলে একটি গ্রন্থই সরাসরি প্রকাশ করে ফেললেন অন্নদাশঙ্কর। সেই ঘটনাক্রম ঘিরে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে অন্নদাশঙ্করের যে আলাপচারিতা, সেখানে উপস্থিত থাকার স্মৃতি রোমন্থন করে বলতে পারা যায়, বঙ্গবন্ধুর সেই নির্মম হত্যাকাণ্ড ব্যক্তি জ্যোতিবাবুকে কতখানি আহত করেছিল সেই কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারা গিয়েছিল।</p> <p>বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নে জ্যোতিবাবু যে কতখানি উদ্বিগ্ন ছিলেন সেদিনের কথোপকথনের প্রসঙ্গে তা বারবার মনে হয়েছিল।</p> <p>শেখ হাসিনা প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় সম্মান দিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়কে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। সেই সময় অন্নদাশঙ্করের পাসপোর্টটি অকেজো হয়ে পড়েছিল। বিষয়টি নিবন্ধটিকার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে জানাতেই সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার সমাধান হলো। সেই সময়ে পাসপোর্টের আবেদনপত্রে একটা কলাম ছিল, যেখানে আবেদনকারীর পরিচিত, অর্থাৎ যিনি আবেদনকারীকে চেনেন, এমন দুজনের নাম লিখতে হতো। অন্নদাশঙ্কর সেখানে অবলীলায় লিখে দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।</p>