<p>গাজীপুরে পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তাঁর। কলকারখানায় করেছেন যথেচ্ছ চাঁদাবাজি। কাগজে-কলমে প্রকল্প দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। </p> <p>সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগে অনৈতিক আরো অনেক ব্যবসার মাধ্যমে তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক বনেছেন। রয়েছে বনভূমিসহ বিভিন্ন জায়গা দখল এবং বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ।</p> <p>এসব অভিযোগ গাজীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজের বিরুদ্ধে।</p> <p>অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে ‘রাতের ভোটে’ গাজীপুর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন তিনি। তারপর পুরো সংসদীয় এলাকাকে (শ্রীপুর উপজেলাসহ গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর, ভাওয়াল গড় ও পিরুজালী ইউনিয়ন) তিনি বানিয়ে ফেলেন ‘টাকা আয়ের কারখানা’।</p> <p>রাজধানী ঢাকাসহ গাজীপুর শহরে সবুজের স্ত্রী নিগার সুলতানা ঝুমার রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। ছোট ভাই শাখাওয়াত হোসেন সাবেক এমপির প্রভাব খাটিয়ে বিপুল টাকার মালিক বনেছেন। </p> <p>এলাকার লোকজনের ভাষ্য, ২০১৮ সালে দল থেকে মনোনয়ন পান মুহাম্মদ ইকবাল হোসেন সবুজ। এরপর মাত্র দুই দিনে পুরো সংসদীয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন তাঁর কর্মী-সমর্থকরা।</p> <p>একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তাঁর  প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের ইকবাল সিদ্দিকী। তাঁকে নির্বাচনী মাঠে নামতেই দেননি সবুজ। এমনকি নিজের লোকজন দিয়ে তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়।</p> <p>স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্য মতে, ওই সময় নির্বাচনী প্রচারে ব্যয়ের জন্য এলাকার শতাধিক কারখানার মালিককে চাঁদা দিতে বাধ্য করেন সবুজ।</p> <p>নাম প্রকাশ না করে সবুজের কয়েকজন কর্মী জানান, ওই সময় বিভিন্ন কারখানার মালিক, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অন্তত ১০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়েছিল।</p> <p>স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, নির্বাচিত হওয়ার পর শ্রীপুর উপজেলাসহ গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর, ভাওয়াল গড় ও পিরুজালী ইউনিয়নের সব কারখানার ঝুট ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেন। কোনো কারখানার মালিক তাঁকে ঝুটের ব্যবসা দিতে রাজি না হলে ক্যাডার বাহিনী ওই কারখানার পণ্য বা তৈরি পোশাকভর্তি গাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে যেত।</p> <p>আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মী মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে জানান, ২০২০ সালের ৯ আগস্ট শ্রীপুর উপজেলার মুলাইদ এলাকায় ব্লু প্ল্যানেট নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার চার হাজার পিস তৈরি পোশাকসহ কাভার্ড ভ্যান ছিনতাই করে নেওয়া হয়। কারখানা থেকে ঝুটের ব্যবসা দিতে গড়িমসি করায় সবুজের নির্দেশে তেলিহাটী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত ফকিরের নেতৃত্বে দিনদুপুরে ওই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পরে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতাদের চাপে ওই ঘটনায় থানা পুলিশ ঘটনার পরদিন মামলা নেয়। ওই ঘটনায় ইকবাল হোসেন সবুজের সহযোগী লিয়াকত ফকিরকে ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রেপ্তার করে গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।</p> <p>স্থানীয় মানুষজন জানায়, এই নির্বাচনী এলাকায় প্রতিটি কারখানা থেকে ঝুট বিক্রি করতেন তাঁর মনোনীত ব্যক্তি। ওই ব্যক্তিকে কোনো কারখানার মালিক ঝুটের ব্যবসা না দিলে ওই কারখানা থেকে ঝুট বের করা যেত না।</p> <p>স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি জানান, একসময় শ্রীপুর পৌর এলাকার বৈরাগীর চালায় আমানটেক্স লিমিটেড কারখানায় ঝুটের ব্যবসা করতেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। সবুজ এমপি হওয়ার পর ঝুটের মাল বের করতে গেলে জাহাঙ্গীর আলমের লোকজনকে মারধর করে ঝুটের মাল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সে সময় সবুজ ও জাহাঙ্গীর আলমের লোকদের মধ্যে গোলাগুলিও হয়। পরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মধ্যস্থতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে কারখানার মালিক সবুজকে ঝুটের ব্যবসা দিতে বাধ্য হন।</p> <p>খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারখানাভেদে অনেক ধরনের ঝুট পণ্য রয়েছে। সেগুলোর প্রতিটির আলাদা রেট। কিন্তু সবুজ সেসবের একদমই ধার ধারতেন না।</p> <p>ঝুট ব্যবসা থেকে ৬৬০ কোটি টাকা : গাজীপুর ও শ্রীপুরে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে পাঁচ শ কারখানায় ছিল সবুজের একচ্ছত্র  ঝুট ব্যবসা। প্রতি মাসে প্রতিটি কারখানা থেকে সর্বনিম্ন দুই লাখ থেকে ২০ লাখ টাকার ঝুটের পণ্য বের হয়। কারখানাসংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানান, সেই হিসাবে সব খরচ বাদে প্রতি মাসে ঝুট ব্যবসা থেকেই সবুজের আয় হতো ১১ কোটি টাকা। তিনি সংসদ সদস্য থাকাকালে পাঁচ বছরে ঝুটের ব্যবসা থেকে কামিয়েছেন ৬৬০ কোটি টাকা।</p> <p>ইজারা ছাড়াই নদ থেকে বালু উত্তোলন : বানার নদটির শ্রীপুর অংশে বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয় না প্রায় দেড় যুগ ধরে। তবে সবুজ সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে তাঁর মনোনীত ব্যক্তিরা বালু উত্তোলন শুরু করেন। নদটির তিনটি অংশ থেকে তখন অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলত। বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একজন জানান, প্রতি মাসে সবুজকে দেওয়া হতো পাঁচ লাখ টাকা।</p> <p>করোনাকালে প্রতারণা ও চাঁদাবাজি : ২০২০ সালের ৩১ মার্চ গাজীপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে সবুজ ঘোষণ দেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে কর্মহীন ১৫ হাজার দরিদ্র মানুষের দায়িত্ব নিলেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, কিন্তু ওই দিন মাত্র ৫০০ জন দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। এরপর কখনোই কারো আর খোঁজ নেননি তিনি। কিন্তু দরিদ্র মানুষকে ওই খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কথা বলে শতাধিক কারখানার মালিকদের কাছ থেকে সবুজ কয়েক কোটি টাকা চাঁদা নেন।</p> <p>একসময় তাঁর সঙ্গে রাজনীতি করা জেলা পর্যায়ের এক নেতা জানান, কোনো শিল্প মালিকের  কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকার নিচে চাঁদা নেননি তিনি।</p> <p>সবুজের মদদে বনভূমি দখল : শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটী ইউনিয়নের টেংরা এলাকায় সবুজের ১১ বিঘা পৈতৃক জমি রয়েছে। জমিটি বন বিভাগের গেজেট নোটিফিকেশনভুক্ত। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বন বিভাগের সঙ্গে যৌথ সীমানা নির্ধারণের (ডিমারকেশন) জন্য আবেদন করেন তাঁর ছোট ভাই শাখাওয়াত হোসেন। কিন্তু বন বিভাগ তাঁর পক্ষে প্রতিবেদন দেয়নি। এতে বন বিভাগের ওপর বেশ চটে যান সবুজ। ওই বছর সেপ্টেম্বরে শ্রীপুর উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির মাসিক সভায় উপস্থিত থাকা বন বিভাগের প্রতিনিধি রেঞ্জ কর্মকর্তাকে (শ্রীপুর) অপদস্থ করেন তিনি।</p> <p>ওই দিন সভায় সবুজ ঘোষণা দেন, ‘অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে বনভূমি দখল করে। আগে সেগুলো উদ্ধার করেন। দরিদ্র মানুষ কেউ যদি বনভূমি দখল করে বসতঘর নির্মাণ করে, সেখানে গেলে পিঠের চামড়া থাকবে না।’ বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সবুজের ওই ঘোষণার পর মাত্র এক মাসের ব্যবধানে শুধু শ্রীপুরেই বনভূমি দখল করে প্রায় আড়াই শ ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। ঘরবাড়ি নির্মাণকালে বাধা দিতে গেলে বন বিভাগের কর্মীদের ওপর হামলা চালানো হতো।</p> <p>বন বিভাগের একজন বিট কর্মকর্তা জানান, বনভূমি দখল করে শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণে মদদই দেননি সবুজ, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজেন্দ্রপুর রেঞ্জের পূর্ব বিটের টেকপাড়া এলাকায় সুফল রিসোর্টে (গ্রেডি স্টুডিও) যাওয়ার জন্য সরকারি সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে রাস্তা করার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। পরে বন বিভাগের কর্মীরা খুঁটি পুঁতে ও চারা রোপণ করে ওই রাস্তা বন্ধ করে দেন। কিন্তু সবুজ ওই বছরের ১১ অক্টোবর নিজে দাঁড়িয়ে রাস্তাটি চালু করেন।</p> <p>স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, ওই রাস্তা চালু করে রিসোর্টের মালিকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেন তিনি।</p> <p>দেশের বাইরে বাড়ি-ফ্ল্যাট, ব্যবসা : সবুজের খুব কাছের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করে জানান, বর্তমানে অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক সবুজ। তবে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে দেশে তাঁর তেমন কোনো সম্পদের খোঁজ মেলেনি। ওই টাকা পাচার করেছেন দেশের বাইরে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরে তাঁর বাড়ি-ফ্ল্যাট রয়েছে। সেখানে তাঁর স্বর্ণের ব্যবসাও রয়েছে।</p> <p>গৃহিণী থেকে রাতারাতি বড় ব্যবসায়ী স্ত্রী : ২০১৮ সালে সবুজের স্ত্রী নিগার সুলতানা ঝুমা ছিলেন গৃহিণী। তখন তাঁর কাছে নগদ কোনো টাকা ছিল না। ব্যাংকে ছিল পাঁচ লাখ ২৬ হাজার টাকা এবং পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ১০০ ভরি স্বর্ণ। কিন্তু সবুজ এমপি হওয়ার পর পাঁচ বছরে তাঁর স্ত্রীর সম্পদ বহুগুণ বেড়ে যায়। বনে যান ব্যবসায়ী। নির্বাচনী হলফনামা থেকে এসব তথ্য মিলেছে। ব্যবসা খাতে ২০২৩ সালে তাঁর স্ত্রীর আয় দেখিয়েছেন ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক সুদ পেয়েছেন ৪৫ হাজার টাকা। হাতে নগদ টাকা ৫০ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ব্যাংকে জমা ১০ লাখ ৮১ হাজার টাকা, স্বর্ণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ ভরি। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে, প্রকৃত সম্পদের সঙ্গে হলফনামায় দেওয়া তথ্যের মিল নেই। ঝুমার নামে গাজীপুর শহরে উত্তর ও দক্ষিণ ছায়াবীথি এলাকায় এবং রাজধানীর খিলগাঁওয়ে কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে।</p>