<p>কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়া সংসদীয় আসনে জাফর আলম (৬৫) ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর আগে ছিলেন চকরিয়া পৌরসভার মেয়র ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। এসব পদে থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরে ওই এলাকায় একাই ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কয়েক শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক বনে যান। যে দলের মনোনয়ন নিয়ে তিনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই দলের বাইরে গড়ে তুলেছিলেন ‘জাফর লীগ’।</p> <p>তাঁর অস্ত্রধারী বাহিনীর হাতে চকরিয়ার রাজপথে বিএনপি-জামায়াতের পাঁচজন কর্মী নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বাহিনীর লুটপাট থেকে রক্ষা পায়নি গ্রামীণ ব্যাংকের ৩০০ একরের চিংড়িঘের।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা যায়, জাফর আলম স্থানীয় সরকারে মেয়র, চেয়ারম্যান এবং জাতীয় সংসদে এমপি পদ লাভের সুযোগে তাঁর নির্বাচনী এলাকার অঘোষিত শাসনকর্তায় পরিণত হন। তাঁর বেপরোয়া আচরণে এলাকায় কায়েম হয় ত্রাসের রাজত্ব।</p> <p>তাঁর পিএস আমিন চৌধুরী, ভাতিজা জিয়াবুল হক ও ভাগিনা মিজান, ইউপি চেয়ারম্যান আদর, নবী হোসেন ও জামালের নেতৃত্বে এলাকায় গড়ে তোলা হয় জাফর লীগের ক্যাডার বাহিনী। গত ১৫ বছরে অর্ধশত সদস্যের এই ক্যাডার বাহিনী দিয়ে চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলায় খুনখারাবি, সাধারণ মানুষের ও সরকারি জায়গাজমি দখল, গরুচুরি, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অপকর্ম করে শত শত কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন জাফর আলম। মালিক হয়েছেন গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমির। চকরিয়ার চিংড়ি জোনের অন্তত ১৫ হাজার একর ঘের ছিল তাঁর বাহিনীর দখলে।</p> <p>একসময় অর্থসংকটে সংসার চালাতেও হিমশিম খাওয়া জাফর আলম বর্তমানে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা সদরে কয়েকটি শপিং কমপ্লেক্সসহ অনেক স্থাবর সম্পত্তির মালিক। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, পাহাড় ও নদীর অবৈধ বালু উত্তোলন, সরকারি বরাদ্দ লুট, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে মালিক বনেছেন অঢেল সম্পদের।</p> <p>চকরিয়ার ইলিশিয়া গ্রামের প্রয়াত জমিদার মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর ছেলে শাহ জামিল ইবনে মোস্তাক ও মেয়ে নিলুফার বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক এমপি জাফর আলম জালজালিয়াতির মাধ্যমে আমাদের প্রয়াত মা সলিমা বেগমের ২৬ একর ও খালা রিজিয়া বেগমের ১০ একর জমি জবরদখল করে নিয়েছেন। এর প্রতিকার পেতে তাঁরা আদালত ও দুদকের শরণাপন্ন হয়েছেন।</p> <p>তাঁরা আরো জানান, মৃতকে জীবিত দেখিয়ে চকরিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসে জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে জাফর আলমের বিরুদ্ধে।</p> <p>চকরিয়া উপজেলার বড় ভেওলা মৌজার লাল ব্রিজ এলাকার বেশ কিছু জমি জালিয়াতি করে জাফর আলমের স্ত্রী শাহেদা বেগম, মেয়ে তানিয়া আফরিনসহ অন্যদের নামে রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হয়েছে। পেকুয়া কবির আহমদ চৌধুরী বাজার সংলগ্ন বিশাল এলাকার জমি জোরজবরদস্তি করে দখলে নিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে শপিং কমপ্লেক্স। চকরিয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ভরামুহুরী এলাকায় স্ত্রী শাহেদা বেগমের নামে বিশাল আয়তনের জমি কিনে নেন তিনি। সেই জমির দখল নিতে গিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা সোহেল খুন হন। এখনো পর্যন্ত সেই খুনের বিচার হয়নি।</p> <p>ভুক্তভোগীরা জানায়, জাফর লীগের হাতে বিএনপি-জামায়াতের পাঁচ নেতাকর্মীই কেবল নিহত হননি, হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মাতামুহুরী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহসিন বাবুল, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক আলমগীর হোছাইন, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক শফিকুল আলম বাহার, আওয়ামী লীগ নেতা আনন্দ মোহন, মাতামুহুরীর সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল দরবেশী, পৌরসভা যুবলীগের সভাপতি হাসানগীর হোছাইন ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মারুফ হোসেন। এই বাহিনীর সর্বশেষ হামলার শিকার হন স্থানীয় বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীও।</p> <p><strong>ডাকাতদলের পৃষ্ঠপোষক</strong></p> <p>চকরিয়া উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন যথাক্রমে ডুলাহাজারা, চিরিঙ্গা ও সাহারবিল এলাকায় রয়েছে অন্তত ৩০০ সদস্যের কয়েকটি ডাকাতদল। এসব ডাকাতদলের নিয়ন্ত্রণও সাবেক এমপি জাফরের হাতে। সম্প্রতি ডুলাহাজারায় ডাকাত প্রতিরোধ করতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে নিহত হন সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজিম। স্থানীয় অনেকের ধারণা, এই হতাকাণ্ডে জড়িত ডাকাতদলের পৃষ্ঠপোষক সাবেক এমপি জাফরের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আদর। চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগর ঘোনা নামের গ্রামটি সাবেক এমপি জাফরের একনিষ্ঠ সমর্থকদের বলে পরিচিত। সেই গ্রামেও রয়েছে শতাধিক ডাকাত। এসব ডাকাতের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকার বিষয়টি স্থানীয়রা অবহিত।</p> <p><strong>গ্রামীণ ব্যাংকের চিংড়িঘের লুট</strong></p> <p>এমপি জাফর আলমের দখল থেকে বাদ যায়নি নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ৩০০ একরের আধুনিক পদ্ধতির চিংড়িঘের। ২০২১ সালে চকরিয়া উপকূলে গ্রামীণ চিংড়িঘেরটি জাফর বাহিনী দখল করে নিয়ে কয়েক কোটি টাকার মাছসহ অন্যান্য সম্পদ লুটপাট করে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গ্রামীণ ব্যাংক কর্দৃপক্ষ দখলমুক্ত করে ঘেরটি। সে সময় বিষয়টি নিয়ে চকরিয়া থানায় মামলা হলেও ক্ষমতার দাপটের কারণে মামলায় জাফর আলমের লোকজনকে আসামি করা সম্ভব হয়নি।</p> <p>গ্রামীণ ব্যাংকের অধীন গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন পরিচালিত ৩০০ একর আধুনিক চিংড়িঘেরের ব্যবস্থাপক উৎপল কান্তি চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘেরটি তিন বছর এক মাস পর গত ৮ আগস্ট দখলমুক্ত হয়েছে। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার রামপুর মৌজার গ্রামীণ চিংড়িঘেরটিতে সাবেক এমপি জাফর আলমের নির্দেশে ২০২১ সালের ৫ জুলাই রাতে ৩০ থেকে ৩৫ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী হানা দিয়েছিল। সেই রাতে সন্ত্রাসীরা ইঞ্জিনচালিত বোটের মাধ্যমে আলমারি, খাট, অফিসকক্ষের ফার্নিচার ও মূল্যবান কাগজপত্র লুট করে নিয়ে যায়।</p> <p>ব্যবস্থাপক জানান, দেশের সর্বপ্রথম আধানিবিড় (সেমি ইনটেনসিভ) পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ শুরু করা হয়েছিল এই ঘেরে। ঘেরটি দখলের পর তিন বছরের জন্য সাবেক এমপি জাফর আলম চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনকে পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে লিজ দিয়েছিলেন বলে জেনেছি। সাবেক এমপি জাফরের দখলবাজ সন্ত্রাসীরা ঘেরের প্রায় দুই হাজার নারকেলগাছ কেটে ও উপড়ে ফেলে। এতে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি পুরো প্রকল্পের মারাত্মকভাবে সৌন্দর্যহানিও হয়েছে।</p> <p>উৎপল চৌধুরী জানান, সেই সময় তিনি চকরিয়া থানায় মামলা করতে গিয়েও সাবেক এমপি এবং ঘটনায় জড়িত প্রকৃত সন্ত্রাসীদের নাম এজাহারে দিতে পারেননি। মাত্র চার ব্যক্তির নাম উল্লেখসহ আরো কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে তিনি কোনো রকমে একটি মামলা দিতে পেরেছিলেন। সেই মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।</p> <p>জানা যায়, জাফর আলমের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তাধীন। জাফর আলমের বিরুদ্ধে খুন-ডাকাতিসহ ডজনখানেক মামলাও রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, চকরিয়া- পেকুয়া উপজেলার ভয়ংকর সব অপরাধের সঙ্গে জড়িত সাবেক এমপি জাফর। গত বছরের ১৫ আগস্ট জামায়াত নেতা সাঈদীর গায়েবানা জানাজা থেকে ফেরার পথে মুসল্লিদের ওপর জাফর আলমের নেতৃত্বে গুলিবর্ষণ করা হয়। এ সময় ফোরকান নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।</p> <p> গত ৩ ও ৪ আগস্ট তাঁর নেতৃত্বে চকরিয়া পৌর শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালে তিনিও আত্মগোপনে চলে যান। গাঢাকা দেয় তাঁর বাহিনীর লোকজনও। ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা চিরিঙ্গা স্টেশনে জাফর আলমের মালিকানাধীন মার্কেট সিস্টেম প্লাজায় অগ্নিসংযোগ করে।</p> <p>পলাতক থাকায় জাফর আলম সম্পর্কে এত সব অভিযোগের বিষয়ে তাঁর কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।</p>