<p>পোশাক শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা থামছে না। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়া হলেও বকেয়া পাওনার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করেন বার্ডস গ্রুপের শ্রমিকরা। রাত সাড়ে ৮টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে সড়কে অবস্থান করছিলেন তাঁরা। তাঁরা বলেন, বকেয়া না পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা রাস্তা ছাড়বেন না। </p> <p>গতকাল সচিবালয়ে শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, গুজব ছড়িয়ে পোশাক কারখানাগুলোতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে। তিনি গত সোমবার নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানান।</p> <p style="text-align:justify">শ্রমিকরা বলছেন, এর আগে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধমে তাঁদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। ফলে তাঁরা সার্ভিস বেনিফিট ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে গত সোমবার সকাল থেকে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছেন। </p> <p>এ বিষয়ে তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ, শিল্প পুলিশ ও কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ কেউ তাঁদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। জানা যায়, বার্ডস গ্রুপের মালিক পলাতক। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বার্ডসের শ্রমিকদের পাওনা।</p> <p>শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ১৪টি কারখানা বন্ধ ছিল। এর মধ্যে সাতটিতে সাধারণ ছুটি এবং সাতটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী ৩৪টি কারখানা বন্ধ ছিল। আশুলিয়ায় ৩১টি এবং গাজীপুরে ১৩টি কারখানা।</p> <p>সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিল্পাঞ্চলের কোথাও কোনো ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বন্ধ থাকা মণ্ডল নিটওয়্যার কারখানাটিও খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এতে ওই কারখানার শ্রমিকরাও শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দিয়েছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে কারখানার সামনে যৌথ বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে। তবে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানার বেশির ভাগ শ্রমিকই গতকাল কাজে যোগ দেননি।</p> <p>শিল্প পুলিশ জানায়, গতকাল সকাল থেকে শিল্পাঞ্চলের জিরাবো রোডে এআর জিন্স প্রডিউসার লিমিটেড ছাড়া বাকি সব কারখানা চালু রয়েছে। কাঠগড়া এলাকার এআর জিন্স প্রডিউসার লিমিটেড, টঙ্গাবাড়ী এলাকায় ম্যাঙ্গো টেক্স লিমিটেড, বাইপাইল এলাকার স্কাইলাইন কারখানা এবং সেতারা গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা সবেতনে ছুটিতে রয়েছে।</p> <p>তবে টঙ্গাবাড়ী এলাকার মণ্ডল নিটওয়্যার, ন্যাচারাল ডেনিম, ন্যাচারাল ইন্ডিগো, জামগড়া ও নরসিংহপুর এলাকার এনভয়, দ্য রোজ, হা-মীম, শারমীন, মেডলারসহ অন্য সব কারখানা চালু রয়েছে।</p> <p>আশুলিয়া শিল্প পুলিশ ১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে উত্পাদন কার্যক্রম চলছে। শ্রমিকরা সকালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কারখানায় প্রবেশ করে কাজে যোগদান করায় কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তবে শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় সাতটি কারখানা বন্ধ এবং সাতটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।</p> <p>শ্রমিকরা বলছেন, গত ২৮ আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার বার্ডস গ্রুপের সব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সময় শ্রমিক-কর্মচারীদের আগস্ট মাসের বেতন ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এবং সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। শ্রমিকদের বেতনের টাকা পরিশোধ করলেও ৩০ সেপ্টেম্বর সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদানে আরো তিন মাস সময় চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নির্ধারিত টাকা পরিশোধ না করায় শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।</p> <p>বার্ডস গ্রুপের নারী শ্রমিক বিদিশা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত সোমবার আমাদের আইনগত পাওনাদি পরিশোধের কথা ছিল, কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো ধরনের পাওনাদি পরিশোধ না করে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে। আমরা পাওনাদি না পাওয়া পর্যন্ত অবরোধ প্রত্যাহার করব না।’ </p> <p>আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘সার্ভিস বেনিফিট ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে শ্রমিকরা সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। আমরা তাঁদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু শ্রমিকরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সড়ক ছাড়বেন না বলে জানিয়েছেন। আমরা কারখানাটির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। এ ছাড়া বিজিএমইএসহ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’</p> <p>অন্যদিকে আশুলিয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর গুলিতে শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় এক ঘণ্টা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। এ সময় তাঁরা বলেন, পতিত ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার সরকারের আমলে যেভাবে পাখির মতো গুলি করে ছাত্র-শ্রমিক জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, এখনো তা চলছে। এভাবে চলতে পারে না। শ্রমিক হত্যার কঠোর শাস্তি ও বিচার দাবি করেন তাঁরা।</p> <p><strong>১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ :</strong> গতকাল শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, গুজব ছড়িয়ে পোশাক কারখানাগুলোতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেশের সার্বিক আইন পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব তথ্য জানান। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।</p> <p>শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘গতকাল শ্রমাঞ্চলে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। একজন শ্রমিক নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করছি। নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ১৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। আহতদের সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে।’</p> <p>ঘটনার বিবরণ দিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, গতকালও নারী শ্রমিককে ধর্ষণ ও দুজনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ডেডবডি পড়ে আছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। শ্রমিকদের ভেতর থেকে কোনো অনুপ্রবেশকারী প্রথমে গুলি ছোড়ে। সেখান থেকেই বিক্ষোভের সূত্রপাত। পুলিশের একজন কর্মকর্তাও মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। ১৩ জন আহত হয়েছে।</p> <p> </p> <p><strong>আশুলিয়ার ঘটনায় মামলা, গ্রেপ্তার ৩৬ :</strong> আশুলিয়ায় গতকাল যৌথ বাহিনীর ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা, মারধর ও কারখানায় অনুপ্রবেশ করে লুটপাটের অভিযোগে করা মামলায় ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। </p> <p>এ ঘটনায় গতকাল আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাশেদ মিয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় এক হাজার ২০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। পরে দুপুরে গ্রেপ্তার করা আসামিদের ঢাকার আদালতে পাঠায় আশুলিয়া থানা পুলিশ।</p> <p>আশুলিয়া থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় এক হাজার ২০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। একজন পুলিশ সদস্য বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। এ ঘটনায় ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আজ আদালতে পাঠানো হয়েছে।</p> <p><strong>যানজটে দিনভর স্থবির গাজীপুর : </strong>একটি কারখানার শ্রমিকরা দুই মহাসড়ক অবরোধ করায় যানজটে গতকাল দিনভর স্থবির ছিল গাজীপুর। জুলাই মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে মহানগরীর মোগরখাল এলাকার টি অ্যান্ড জেড গ্রুপের এপিএল অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা সকালে ভোগড়া বাইপাস এলাকায় ওই অবরোধ করেন। এই প্রতিবেদন লেখার সময় সন্ধ্যা সোয়া ৬টা পর্যন্ত শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে অবস্থান করছিলেন।</p> <p><strong>নারায়ণগঞ্জে পারটেক্স পার্টিকেলসের শ্রমিকদের বিক্ষোভ :</strong> নারায়ণগঞ্জের বন্দরে বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন পারটেক্স পার্টিকেলস বোর্ড লিমিটেডের শ্রমিকরা। গতকাল দুপুরে বন্দরের নাসিক ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের হরিপুর এলাকায় কারখানার সামনে এই বিক্ষোভ মিছিল করেন বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। পরে সমস্যা সমাধানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শ্রমিকদের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করা হয়।   এ বিষয়ে জানতে কারখানা কর্তৃপক্ষের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেনি।</p> <p>আদমজীতে অবস্থিত শিল্প পুলিশ-৪ পরিদর্শক (গোয়েন্দা) সেলিম বাদশা বলেন, শ্রমিকদের জুলাই মাসের ১০ শতাংশ বেতন অপরিশোধিত। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর শেষ হলেও, এখনো শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। শ্রমিকদের বিক্ষোভের কারণে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শ্রমিকদের প্রতিনিধি, কারখানা কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ, জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বসে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। </p> <p><strong>[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক গাজীপুর, আশুলিয়া প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও সাভার সংবাদদাতা]</strong></p> <p> </p>