<p>১৯৯৮ সালে বিজ্ঞানীদের একটা দল সুপারনোভার পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আসলে তাঁরা খুঁজছিলেন একটা আদর্শ বাতি বা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল।</p> <p>স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল আবার কী জিনিস?</p> <p>ধরা যাক, অজপাড়াগাঁয়ের একটা গ্রাম। সেখানকার মানুষ বিদুৎ কী জানে না। কিন্তু সেখানে হারিকেন আছে, মোমবাতি আছে আবার হ্যাজাগ লাইটও আছে। সেই গ্রাম থেকে একটা লোক শহরে গেল বেড়াতে। তারপর ফিরে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে শহরের অবাক করা সব গল্প শোনাচ্ছে। কথায় কথায় উঠল বৈদ্যুতিক বাতির কথা। হরেক রকম বৈদ্যুতিক বাতি সে দেখে গেছে। কিন্তু সেই বাতির উজ্জ্বলতা কেমন সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করছে। কী জবাব দেবে সেই লোক?</p> <p>শহরে সবচেয়ে অনুজ্জ্বল যে আলোটা দেখে গেছে, সেটাকে সে তুলনা করল মোমবাতির সঙ্গে। তাহলে এখানে মোমবাতি একটা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল। আবার আরেকটু উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাতিকে সে বলল হারিকেনের উজ্জ্বলতার সমান। কিন্তু বেশির ভাগ বাতির উজ্জ্বলতা তার কাছে মনে হয়ে হ্যাজাগ লাইটের উজ্জ্বলতার সমান। এখানে হারিকেন আর হ্যাজাগ লাইটকে আদর্শ ধরে তাদের অন্য বাতির উজ্জ্বলতার ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এতগুলো উদাহরণ না টেনে সে শুধু হারিকেনেরই তুলনা দিতে পারত। বলতে পারত, সবচেয়ে উজ্জ্বল যে বাতিটা দেখে এসেছে, সেটার উজ্জ্বলতা হারিকেনের আলোর উজ্জ্বলতার ১০ গুণ। তেমনি সবচেয়ে অনুজ্জ্বল যে বাতিটা সে শহর থেকে দেখে এসেছে, সেটার উজ্জ্বলতা হারিকেনের আলোর উজ্জ্বলতার অর্ধেক। তাহলে এখানে হারিকেনকে উজ্জ্বলতা মাপার আদর্শ বাতি বা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল ধরা যেতে পারে। </p> <p>মহাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর উজ্জ্বলতা বোঝাতে ব্যবহার করা হয় সূর্যকে। বলা হয় অমুক নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা সূর্যের উজ্জ্বলতার তিন গুণ। তেমনি দূরত্ব পরিমাপ করতে ব্যবহার করা হয় আলোকবর্ষ কিংবা মেগাপার্সেক একক। আলোকবর্ষ হলো আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে সেই পরিমাণ দূরত্ব। আলো ১ সেকেন্ডে অতিক্রম তিন লাখ কিলোমিটার দূরত্ব। তাহলে এক বছরে পেরোয় 9.4607×10<sup>12</sup> কিলোমিটার। আর এক পার্সেক হলো ৩.২৬ আলোকবর্ষ। আর এক মেগাপার্সেক হলো 3.26×10<sup>6 </sup>আলোকবর্ষ। </p> <p>ওই বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের প্রসারণের হার মাপতে চান। এর জন্য তাঁরা একটা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল খুঁজতে চাইলেন। এ জন্য সূর্যকে দিয়ে কাজ চালানো যাবে না। এমন কিছু চাই, যা মহাবিশ্বের প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আবার তার উজ্জ্বলতাও আমরা ব্যবহার করতে পারি। অর্থাৎ উজ্জ্বলতাও যেন ব্যবহার করা যায়। সে জন্য ব্যবহার করা হবে ডপলার ইফেক্ট। তা থেকেই মাপা যায় যেন লোহিত সরণ। কিন্তু সেই বস্তু একটা হলে হবে না। মহাকাশে একই উজ্জ্বলতায় অথচ বিভিন্ন দূরত্বে থাকতে হবে সেসব বস্তু। তাহলেই সেগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল হিসাবে ব্যবহার করে মহাবিশ্বের প্রসারণ মাপা যাবে।</p> <p>আগে সিফড ভ্যারিয়্যাবল স্টার তারারকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে মাপজোখের কাজ চলত। কারণ এই তারাদের সবার উজ্জ্বলতা প্রায় সমান। কিন্তু এর রেড শিফট বা লোহিত সরণ উচ্চমানের নয়। তখন দরকার হয়ে পড়ল আরো উচ্চমানের লোহিত সরণে কাজ করে এমন নক্ষত্রের। শুরু হলো খোঁজ। শেষ বিজ্ঞানীরা পেলেন বিশেষ এক জাতের সুপারনোভার খোঁজ। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি সুপারনোভা কী এবং কিভাবে এর জন্ম হয়। প্রথম সুপারনোভার খোঁজ পেয়েছিলে দুই জার্মান জ্যোতির্বিদ ওয়ার্নার বাড এবং ফ্রিৎজ জুইকি। তারা স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেলের উপযোগী সেই বিশেষ সুপারনোভার খোঁজ পান। সেই বিশেষ সুপারনোভাকে বলা হয় টাইপ ১এ। </p> <p>সুপারনোভাকে দুটি শ্রেণিতে প্রথম ভাগ করা হয় ১৯৪১ সালে। টাইপ ১ এবং টাইপ ২। কিন্তু এই দুটো শ্রেণিই শেষ কথা নয়। ১৯৮০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা দেখলেন শুধু টাইপ ১-এর ভেতরেই রয়েছে তিন ধরনের সুপারনোভা। টাইপ ১এ, টাইপ ১বি আর টাইপ ১সি। এর মধ্যে টাইপ ১এ-র গ্রোত্রভুক্ত সুপারনোভাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। এদের সবার উজ্জ্বলতা, বর্ণালী আর আলোর বিচ্যুতি সমান। সুতরাং এগুলোকে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল হিসেবে ব্যবহারের বেশ সুবিধা আছে বলে মনে করলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। </p> <p>মহাকাশে বাইনারি স্টার বা যুগল তারাদের দেখতে পাওয়া যায়। এরা একে অন্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। শত মহাজাগতিক ঘটনায়ও এরা পরস্পরকে ছেড়ে যায় না। এই যুগল তারাদের দুটোই উজ্জ্বল নক্ষত্র হতে পারে। একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র আরেকটা কৃষ্ণগহ্বর অথবা নিউট্রনস্টার অথবা হতে পারে শ্বেত বামনও। আবার যুগল তারাদের দুটোই কৃষ্ণগহ্বর হতে পারে অথবা উভয়েই নিউট্রনস্টার হতে পারে। কিন্তু এত কিছু আমাদের দরকার নেই। দরকার একটা সুপারনোভা। টাইপ ১এ সুপারনোভা। এই সুপারনোভাদের জন্মপ্রক্রিয়া একটু অন্যরকম।</p> <p>টাইপ ১এ সুপারনোভাদের জন্ম যুগল তারাদের থেকে। তবে যে-সে যুগল তারা হলে চলবে না। সেই যুগল তারা একটা উজ্জ্বল সাধারণ নক্ষত্র থাকবে, আরেকটা থাকবে শ্বেত বামন। এই শ্বেত বামন সঙ্গী নক্ষত্রকে কেন্দ্র শুধু ঘোরেই না। রীতিমতো নক্ষত্রের শরীর থেকে ছিনিয়ে নেয় উত্তপ্ত গ্যাস। সেই গ্যাস জমা হয় শ্বেত বামনের শরীরে। ফলে বাড়তে থাকে শ্বেত বামনের ভর। একসময় এভাবে ভর বাড়তে সেটা আর শ্বেত বামন অবস্থায় থাকতে পারে না। সেটার ভর তখন চন্দ্রশেখর লিমিট ছাড়িয়ে যায়। সূর্যের ভরের ১.৪ গুণ ভরকে বলে চন্দ্রশেখর লিমিট। মৃতপ্রায় কোনো নক্ষত্রের চন্দ্রশেখর লিমিটের বেশি হলে সেটাতে প্রবল একটা বিস্ফোরণ ঘটে। সেই বিস্ফোরণের উজ্জ্বলতা অনেক বেশি—আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মোট উজ্জ্বলতার সমান। সুতরাং এই সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটানো নক্ষত্রটিই তখন খুব সহজেই আমাদের চোখে ধরা পড়ে। </p> <p>১৯৮৬ সাল থেকে বিজ্ঞানীরা হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন এ ধরনের সুপারনোভা বিস্ফোরণ। অর্থাৎ এমন বিস্ফোরণ ঘটা, যেসব তারা সেই টাইপ ১এ সুপারনোভাদের খুঁজছিল। কিন্তু সুপারনোভাকে চাইলে খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা গ্যালাক্সিতে এক শ বছরে সব টাইপ মিলিয়ে মাত্র দু-তিনটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে। আর যদি হয় টাইপ ১এ সুপারনোভা, তাহলে সেটা এক হাজার বছরে একটা দেখা যেতে পারে। তবু কি বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়েন? মহাকাশে তো শুধু আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিই নেই, রয়েছে কোটি কোটি গ্যালাক্সি। সেসব গ্যালাক্সির কোথাও কোথাও টাইপ ১-এ সুপারনোভা দেখা যেতে পারে। কিন্তু সব গ্যালাক্সিই তো আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই। অতি শক্তিশালী নভো টেলিস্কোপ দিয়েও সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তবু বিজ্ঞানীরা দমলেন না, তাঁরা অনুসন্ধান চালিয়ে গেলেন। ১৯৮৮ সালের মধ্যে মাত্র একটি টাইপ ১এ সুপারনোভা খুঁজে পেলেন। কিন্তু সেটাই উৎকৃষ্ট স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল নয়। কারণ যে সময়টাতে সুপারনোভা সবচেয়ে উজ্জ্বল পর্যায়, সেই সময়টা পেরিয়ে এসেছে ওটা। সুতরাং ওটা থেকে যে লোহিত সরণ পাওয়া গেল, সেটা বিজ্ঞানীদের খুব বেশি সাহায্য করতে পারল না।</p> <p>এ ঘটনার পর বিজ্ঞানীরা হাতাশ হলেন। কিন্তু দমে গেলেন না। ১৯৯৮ সালে একটা প্রকল্প হাতে নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষক সল পার্লমুটার। প্রকল্পটির নামে সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্ট—সংক্ষেপে এসসিপি। যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, সুইডেন ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জ্যোতির্বিদরা যোগ দিলেন এই প্রজেক্টে। চলল তাঁদের মরীয়া খোঁজ। এ জন্য তাঁদের যন্ত্রপাতির উন্নয়ন ঘটাতে হয়েছিল। এমন টেলিস্কোপের দরকার হয়ে পড়েছিল যেন বহুদূরের কোনো গ্যালাক্সিতে ঘটা সুপারনোভা বিস্ফোরণও  চোখ এড়িয়ে না যায়। </p> <p>১৯৯২ সালে এসসিপির বিজ্ঞানীরা সফল হলেন। তাঁরা একটা টাইপ ১এ সুপারনোভার সন্ধান পেলেন। বিজ্ঞানীরা সেটার নাম দিলেন এসএন১৯৯২বিআই। এই সুপারনোভা বাড়িয়ে দিল বিজ্ঞানীদের আত্মবিশ্বাস। একটি সুপারনোভার বিষয়ে  তাঁরা সন্তুষ্ট নন। একটির লোহিত সরণ পর্যবেক্ষণ করে গোটা মহাবিশ্বের প্রসারণের সঠিক হার কাঁটায় কাঁটায় মাপা সম্ভব নয়। তখন তাঁরা উদ্যোগী হলেন আরো বেশি বেশি সুপারনোভা কিভাবে পাওয়া যায় সে চেষ্টা করতে। এ জন্য যন্ত্রপাতির আরো উন্নতি ঘটানোর কথা ভাবলেন। এমন এক সিস্টেম তাঁরা দাঁড় করালেন, যেন মহাকাশের যেকোনো অঞ্চল থেকে আসা সুপারনোভার আলোই শনাক্ত করা যায়। সে যতই দুর্বল আলো হোক। সে মতো সিস্টেমও তৈরি হলো। শুরু হলো অনুসন্ধান।</p> <p>১৯৯৪ সালে দুই মার্কিন গবেষক ব্রায়ান শ্মিড আর নিকোলাস সানেজফের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করল আরেকটি সুপারনোভা সার্চ টিম। দলটার নাম হাই-জেড সুপারনোভা সার্চ টিম। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডাম রিজসহ সে সময়কার জ্যোতির্বিদ্যার রথী-মহারথীরা। দুটি দল দুই দিক থেকে খোঁজ শুরু করল। এক বছরের মধ্যে সফল হলো। ১৯৯৭ সালে আবার এলো এসসিপি দলের সাফল্য। তাঁরা খুঁজে পেলেন এসএন১৯৯৭এপি নামের আরেকটা টাইপ ১এ সুপারনোভা। ১৯৯৭ সালের ভেতরে মোট চল্লিশটা টাইপ ১এ সুপারনোভা।</p> <p>অন্যদিকে হাইজেড সুপারনোভা সার্চ টিম ১৬টি সুপারনোভা খুঁজে পেল। দুই দলের বিজ্ঞানীরা দুই দিক থেকে সুপারনোভার ডাটা পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন। ১৯৯৮ সালে সল পার্লমুটার একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। অন্যদিকে অ্যাডাম রিজও প্রকাশ করলেন একই রকম আরেকটা গবেষণাপত্র। দুই দলের গবেষণাতেই একটা বিষয় নিশ্চিত হলো, মহাবিশ্বের প্রসারণ কমছে না, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রসারণের গতি বাড়ছে। তারা আরো বললেন, মহাবিশ্বের জ্যামিতি আসলে সমতল। তাঁরা হিসাব করে দেখলেন বিগ ব্যাংয়ের পরপরই মহাবিশ্বের ত্বরিত প্রসারণ ছিল না। তখন স্বাভাবিক হারেই প্রসারিত হচ্ছিল এই মহাবিশ্ব। কিন্তু বিগ ব্যাংয়ের ৭০০ কোটি বছর হঠাৎ করেই এই প্রসারণ ত্বরিত হারে ঘটতে শুরু করে।</p> <p>সূত্র : সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান</p>
