<p>মানুষের বিনোদনের ধরন বিভিন্ন রকমের হতে পারে, কিন্তু সহিংসতা বা রক্তপাত (ভায়োলেন্স) নিয়ে নির্মিত সিনেমা বা শো-এর প্রতি অনেকের বিশেষ আগ্রহ লক্ষ করা যায়। এটা একদমই নতুন কোনো ঘটনা নয়। বাস্তবে আমরা এমন অনেক গল্প বা সিনেমার প্লট দেখি যেখানে হত্যাকাণ্ড, লড়াই, এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতি থাকে, যা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে। প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন এসব ভায়োলেন্ট কন্টেন্ট দেখতে পছন্দ করে? এর পেছনে মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে? আসুন সহজ ভাষায় এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করি।</p> <p>মানুষের জীবনে নানা ধরনের আবেগের প্রকাশ হয়—ক্রোধ, হতাশা, উত্তেজনা ইত্যাদি। তবে বাস্তবে সবসময় এই আবেগগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। সিনেমায় যখন আমরা ভায়োলেন্স দেখি, তখন এক ধরনের ‘আবেগীয় মুক্তি’ ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় মানুষ নিজেকে কল্পনাজগতে স্থাপন করে, যেখানে তারা নিজেদের ভেতরের জমে থাকা হতাশা বা ক্ষোভের মতো আবেগগুলোর থেকে সাময়িক মুক্তি পায়। এটা এক ধরনের মনের শুদ্ধি যা মানুষকে মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।</p> <p>সহিংসতা আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাপনের একটি স্বাভাবিক অংশ ছিল। সেই সময় জীবনের জন্য লড়াই করতে হতো, শিকার করতে হতো, শত্রুদের থেকে বাঁচতে হতো। যদিও সভ্যতা এগিয়েছে এবং আমরা শান্তিপূর্ণ সমাজে বাস করছি, তবে সেই আদিম প্রবৃত্তিগুলো আমাদের মস্তিষ্কে থেকে গেছে। সিনেমায় ভায়োলেন্স দেখে আমরা সেই প্রাচীন প্রবৃত্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। এই উত্তেজনা বা উত্তরণের মুহূর্তগুলো আমাদের মস্তিষ্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, যা অনেকের জন্য উপভোগ্য হতে পারে।</p> <p>ভায়োলেন্ট সিনেমা দেখলে আমাদের মস্তিষ্কে অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে, যা এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এটি শারীরিকভাবে বিপদের একটি সঙ্কেত দিলেও, যখন সিনেমার মাধ্যমে সেটা দেখানো হয়, তখন সেটা নিরাপদভাবে উত্তেজনা উপভোগ করার সুযোগ দেয়। এই অ্যাড্রেনালিন রাশ মানুষকে কৌতূহলী করে এবং তাদের বিনোদনের একটি তীব্র অভিজ্ঞতা দেয়।<br /> সহিংসতার সিনেমাগুলো বাস্তব জীবনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ তৈরি করে। সেখানে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঘটার সম্ভাবনা কম। মানুষ এই ভিন্ন জগতে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে পছন্দ করে। এমন এক পৃথিবী যেখানে তারা নিজেদের প্রাত্যহিক সমস্যাগুলো থেকে দূরে রাখতে পারে। এটা বাস্তব থেকে সাময়িকভাবে পালানোর সুযোগ দেয়।</p> <p>অনেক ভায়োলেন্ট সিনেমা বা টিভি শোতে ভালো বনাম খারাপের লড়াই দেখানো হয়। নায়কের বিজয় এবং খলনায়কের পতন এই মুভিগুলোতে প্রায়শই একটি নৈতিক বিচারবোধের প্রতিফলন ঘটায়। এই ধরনের নৈতিক বিজয় মানুষকে সন্তুষ্টি দেয়। মানুষ নিজের জীবনের অন্যায়-অবিচারের প্রতিফলন সেই সিনেমার চরিত্রগুলোর মধ্যে খুঁজে পায় এবং নায়কের বিজয় দেখে নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক শান্তি খুঁজে নেয়।</p> <p>সিনেমা এবং টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলো আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক রীতিগুলো আমাদের চিন্তা-ভাবনা এবং পছন্দকে প্রভাবিত করে। সহিংসতার সিনেমা বা শো এর জনপ্রিয়তা অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক বা সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফল। যখন কেউ দেখে যে এরকম সিনেমা সমাজে বেশ জনপ্রিয়, তখন সে নিজের কৌতূহল মেটানোর জন্য তা দেখে, এবং ধীরে ধীরে এ ধরণের কন্টেন্টের প্রতি আগ্রহ বাড়ে।</p> <p>কিছু মানুষ সহিংসতা দেখে ভয় পেতে বা আতঙ্কিত হতে পছন্দ করে। এই আতঙ্ক বা ভয় দেখার পেছনেও এক ধরনের মনোবৈজ্ঞানিক আকর্ষণ রয়েছে। মানুষ ভায়োলেন্ট সিনেমা দেখে আসলে সেই ভয়কে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে, যা তাদেরকে নিজের ভেতরে এক ধরনের সাহস ও স্থিতিশীলতা এনে দেয়। এই ভয়ংকর অনুভূতি পরে যখন হালকা হয়, তখন এক ধরনের তৃপ্তির অনুভূতি আসে।</p> <p>সহিংসতা বা রক্তপাত সিনেমায় দেখতে পছন্দ করার পেছনে মানুষ বিভিন্ন কারণেই আকৃষ্ট হয়। এটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন আবেগীয় এবং প্রাচীন প্রবৃত্তির প্রতিফলন যা আমাদের জীবনের নানা দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভায়োলেন্সের প্রতি এই আকর্ষণ মনস্তাত্ত্বিকভাবে একদিকে আমাদের পুরনো প্রবৃত্তির প্রতীক আবার অন্যদিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফসল।</p> <p>সূত্র: সায়েন্স ডেইলি</p>