<p>বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার প্রকৃতি, মানুষে-মানুষে ভালোবাসায় ছিল তার উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। প্রকৃতির বর্ণনায় তিনি যে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তা বিশ্বাসাহিত্যেই বিরল। সেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১০০ বছর আগে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। এ দেশের পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর মানুষের জীবনের তিনি পরম মমতা দিয়ে লিগে গেছেন স্মৃতিকথায়। তার পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের স্মৃতি নিয়েই এই আয়োজন...</p> <p>বিভূতিভূষণ এলেন পূর্ব বাংলায় গোরক্ষণী সমিতির প্রচারকাজে নিযুক্ত হয়ে। চাকরি দিয়ে তাকে এখানে পাঠিয়েছিলেন কেশোরাম পোদ্দার নামে এক মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী। পূর্ববঙ্গ ভ্রমণের শৈল্পিক আখ্যান উঠে এসেছে তার অভিযাত্রিক নামের স্মৃতিকথার বইয়ে। গোরক্ষণী সমিতির প্রচারকাজ নিয়ে দুটি কথাও সেখানে ঠাঁই পায়নি। পূর্ব বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, তাদের ভালোবাসা, বিচিত্র জীবনের কাহিনিই লিখে গেছেন এই বইয়ে।</p> <p>কুষ্টিয়া-ফরিদপুর হয়ে মাদারীপুরে এসেছিলেন ‘পথের পাচালী’র  লেখক। সেখানে উঠেছিলেন সরকারি ডাকবাংলোতে। তত দিনে হাতে টাকা-কড়ি যা ছিল শেষ। অবশ্য কেশোরাম পোদ্দার তার জন্য টাকাও পাঠান ডাক বিভাগের মানি অর্ডারে। এখনকার মতো সেকালে বিকাশ-টিকাশের ব্যবস্থা ছিল না। টাকা পাঠানোর জন্য ডাক বিভাগই ভরসা। কিন্তু ডাকপিয়ন কিছুতেই বিভূতিকে টাকা দেবেন না। তিনিই যে বিভূতিভূষণ, কেউ একজন তাকে শনাক্ত করতে হবে। অর্থাৎ মাদারীপুরের কেউ একজন সাক্ষী দেবেন তিনিই বিভূতিভূষণ। কিন্তু এই অচেনা দূরদেশে কে তাকে শনাক্ত করবে? বিভূতি পড়লেন মহাবিপদে, তাকে আরো অনেক জায়গায় যেতে হবে, পকেটে ফুটো পয়সাটিও নেই। সেই অবস্থায় তাকে উদ্ধার করলেন এক মুসলমান ভদ্রলোক। তিনি বিভূতিভূষণের পাশের কামরাতেই উঠেছিলেন। তার দুদর্শা জানতে পেরে স্বউদ্যোগী হয়ে বিভূতিভূষণকে বেশ কিছু টাকা ধার দেন। চাইলে তিনি ডাকপিয়নের কাছে বিভূতিভূষণকে ‘চেনেন’ বলে সাক্ষ্য দিতে পারতেন। কিন্তু অপরিচিতকে ‘চিনি’ বলা তার কাছে অনৈতিক কাজ। সেটা তিনি করতে পারবেন না, বরং গাঁটের পয়সা অপরিচিতকে ধার দিতে তার কুণ্ঠা নেই।</p> <p>বিভূতিভূষণ কলকাতায় ফিরে গিয়ে ভদ্রলোকের উপকারের কথা বলেছিলেন কেশোরাম পোদ্দারকে। পোদ্দার মশাই ভদ্রলোককে একটা চিঠি লিখে ধন্যবাদ দেন এবং মানি অর্ডার করে শোধ করে দেন ভদ্রলোকের টাকাটাও।</p> <p>মাদারীপুর থেকে বিভূতিভূষণের গন্তব্য এবার বরিশালে। স্টিমারে চড়ে গেলেন। আড়িয়াল খাঁ নদী, এর দুই পাশের প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন চিরায়ত বিভূতিভূষণের ঢঙে, ‘সন্ধ্যাবেলায় নৌকা ভিড়ল গ্রামের ঘাটে, বেসাতি করি কখন? কত ধানক্ষেত, কত খেজুরগাছ, তারাভরা রাত। সন্ধ্যায় গ্রামের বধূরা কলসি কাখে জল নিতে এসে গা ধুয়ে নিলে, জলের আলপনা এঁকে চলে গেল বাড়ি ফিরে। কত কথা বলে এই মাঠঘাট, কত দিনের জনপদ বধূদের পদচিহ্ন আঁকা এই নদীর ঘাটের পথটি, বৃদ্ধ বকুল কি বটগাছ…’</p> <p>পূর্ব বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি জীবনানন্দ দাশের মতো কবির জন্ম দিয়েছে, সেই প্রকৃতি, সেই আবহমান বাংলা, নদ-নদী ঘেরা বরিশালে এসে আরণ্যক, ইছামতীর মতো প্রকৃতিনির্ভর উপন্যাস যিনি লিখছেন, তাকে নস্টালজিক না করে পারে!</p> <p>বরিশালের পথে স্টিমারে বিভূতিভূষরে সঙ্গে পরিচয় হয় এক শেকসপিয়ার গবেষকের। ভদ্রলোকের বাড়ি কাউনিয়ায়, এই ভদ্রলোকের নামও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। বিভূতিভূষণের সাহিত্য প্রতিভা তখনো প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু ভেতরে তো জাত সাহিত্যিকের বাস, এমন একজন সমঝদার মানুষ পেয়ে মফস্বলের একজন মানুষ বর্তে যাবেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক। ভদ্রলোক বিভূতিভূষণকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে তার থাকা-খাওয়া বন্দোবস্ত হলো, বয়সে বিভূতিভূষণের সঙ্গে কুড়ি বছরের ব্যবধানও তিনি কমিয়ে এনেছিলেন রসালো সাহিত্য-আলোচনার মাধ্যমে। ভদ্রলোক রোজ বিভূতিভূষণকে নিয়ে প্রকৃতিদশর্নে বের হতেন। বিকেলে পড়তে যেতেন কলেজের লাইব্রেরিতে।<br /> কোন কলেজ?</p> <p>বিভূতিভূষণ কলেজের নাম লেখেননি। আজ থেকে শত বছর আগে বরিশালে কলেজ বলতে তো ওই একটাই। বিএম, অর্থাৎ ব্রজমোহন কলেজ। এই কলেজেই বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল জীবনানন্দ দাশ নিজে লেখাপড়া করেছেন এবং পরে ছাত্র পড়িয়েছেন।</p> <p>বরিশাল থেকে বিভূতিভূষণের গন্তব্য ছিল চট্টগ্রাম আর কক্সবাজার। চট্টগ্রামে গিয়ে ভারি মুশকিলে পড়েছিলেন, ভাষা বোঝেন না, কয়েকটা শব্দ অনুমান করে নিয়ে কোনোমতে কাজ চালিয়েছিলেন।  চট্টগ্রাম থেকে কাউখালী নদীপথে কক্সবাজার পৌঁছলেন। সেখানে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। গোরক্ষণী সমিতির এক ভদ্রলোক নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন বিভূতিভূষণকে। মাঝে মাঝে সমুদ্র দেখতে বেরিয়ে পড়তেন সাম্পানে চড়ে। কতুবদিয়ার লাইট হাউস, আদিনাথ পাহাড়ের চূড়া তার মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল। সম্পানে চড়ে মহেশখালী দ্বীপ দেখতেন দূর থেকে। আদিনাথের মন্দির এখন যেমন বিখ্যাত, ফাগুনে মেলা বসে, তীর্থস্থান; শত বছর আগেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বিভূতিভূষণ লিখেছেন, ‘একটা ছোট পাহাড় সমুদ্রগর্ভ থেকে খাড়া ওপরে উঠেছে- তার মাথায় আদিনাথ শিবের মন্দির। এ অঞ্চলের একটি প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান, অনেক দূর থেকে লোকে আসে আদিনাথ দর্শন করতে, শিবরাত্রির সময় বড় মেলা হয়।’</p> <p>একদিন বিভূতিভূষণের সাধ হলো সোনাদিয়া দ্বীপে যাবেন। সাম্পানের মাঝিকে বললেন সে কথা। মাঝি আপত্তি করেছিল। কিছু একটা বলেছিল বিভূতিকে, তার ভাষা বুঝতে না পারায় বিরাট একটা ভুল হলো। যার জন্য প্রাণ যেতে বসেছিল দুজনের।<br /> সোনাদিয়া গিয়েছিলেন নিরাপদেই। কিন্তু সেখানকার প্রকৃতি, বালুতটে চরে বেড়ানো কাঁকড়া, রংবেরঙের কড়ি আর শামুক-ঝিনুকে বিভোর হয়ে গেলেন বিভূতিভূষণ। পার হয়ে গেল ঘণ্টাখানেক সময়। জোয়ারের সময় ঘনিয়ে এসেছে। মাঝি বলল, ‘বাবু, শিগগিরই ফিরতে হবে। জোয়ার এলো সোনাদিয়া দ্বীপ পুরো পানিতে তলিয়ে যাবে।’</p> <p>তড়িঘড়ি করে সাম্পানে উঠলেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু বিপদ পেছনে লেগেই ছিল। সোনাদিয়া থেকে বেশ কিছুদূর এসে পড়লেন ঘন কুয়াশার খপ্পরে। বিভূতিভূষণের ভাষায় সেটা বঙ্কিমের ‘কপালকুণ্ডুলা’ উপন্যাসের কুয়াশার মতো ছিল। এতটা ঘন যে খুব কাছের জিনিসও দেখা যায় না। এর মধ্যে মাঝি আবার দিক হারিয়ে ফেলল! ভয়ের মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল মাঝির কিছু আশঙ্কা। বড় কোনো জাহাজ যদি এখন এসে পড়ে এ পথে, জাহাজের চালক এই কুয়াশার মধ্যে দেখতে পারবে না। সুতারাং জাহাজ সাম্পান ধাক্কা মেরে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কিংবা সমুদ্রের এখানে-ওখানে বসানো আছে অনেকগুলো বয়া। সেসব বয়াতে গিয়ে সাম্পান ধাক্কা খেলেও নিশ্চিত সলিলসমাধি। সঙ্গে বিভূতিভূষণের নিজেরও একটা আশঙ্কা যোগ হলো। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন মাঝি দিক হারিয়ে ফেলেছে। এখন উল্টো পথে গিয়ে যদি আদিনাথ পাহাড়ের খাড়িতে কোনো বড় পাথরের সঙ্গে সাম্পান ধাক্কা খায়, তবু নিশ্চিত মৃত্যু! শেষমেশ বিভূতিভূষণের আশঙ্কাই সত্যি হয়। সাম্পান গিয়ে ধাক্কা খেল কাউখালী নদীর মোহনায় একটা পাথরের সঙ্গে। ধাক্কাটা জোরেশোরে লাগেনি বলেই শেষমেশ প্রাণে বাঁচলেন।</p> <p>মাঝির আশঙ্কা বিভূতিভূষণ ভড়কে দিলেও বেশি ভয় পাইয়ে দিতে পারেননি। ভবিষ্যতে যিনি চাঁদের পাহাড়ের মতো টান টান রোমাঞ্চে ভরপুর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি যিনি লিখবেন তাকে কি ভয় পেলে চলে?</p> <p>সূত্র : দিনের পর দিন/বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়</p>