<p>ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৪ অনুযায়ী, বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ষষ্ঠ। ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকা রয়েছে ১৬৮তম স্থানে। অন্যদিকে, বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’-এর প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স ২০২৩ অনুযায়ী, যানজটের শহর হিসেবে ঢাকা বিশ্বের পঞ্চম স্থানে। সময় অপচয় ও ট্রাফিক অদক্ষতা সূচকেও শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে এই শহর।</p> <p>আরও দুর্ভাগ্যজনক, আইকিউএয়ারের বায়ু দূষণ সূচক ২০২৪-এ ঢাকার অবস্থান ৯ম। এই মাত্রার বায়ু দূষণের কারণে বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে। এসব পরিস্থিতি ঢাকা শহরের দীর্ঘদিনের সমস্যার প্রতিফলন হলেও এ থেকে উত্তরণের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনও দেখা যায়নি।</p> <p>ঢাকার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা যেমন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়; রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক); দুই সিটি কর্পোরেশন এবং বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন কাজ করছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অসামঞ্জস্যতা, দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে কার্যকর সমাধান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।</p> <p>ঢাকা বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। মাত্র ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের এই শহরে প্রায় এক কোটি দুই লক্ষ নব্বই হাজার মানুষের বসবাস। ফলে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার মানুষের চাপ পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সমস্যা—যেমন অব্যবস্থাপনা, কর্মচারীদের অদক্ষতা, দায়িত্বে অবহেলা, জনবল সংকট, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাব। ফলে দিনে দিনে ঢাকায় বসবাসের পরিস্থিতি খারাপই হচ্ছে।  </p> <p>পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকার এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ এবং সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন।</p> <p>ঢাকার গণপরিবহনের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুণ। বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা এবং অযোগ্যতা যেন এর নিত্যসঙ্গী। পিক আওয়ারে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র ৪.৮ কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির প্রায় সমান। এর পেছনে অনেক কারণ কাজ করছে। পুরোনো ও মানহীন ভাঙাচোরা গাড়ি, অদক্ষ চালক, অননুমোদিত যানবাহনের চলাচল, যেখানে-সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানো এবং গাড়ির জন্য যাত্রীর অপেক্ষা—এসব সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে অবৈধ পার্কিং, রাস্তা ও ফুটপাত দখল, লেন নিয়ম না মানা, অননুমোদিত স্থানে পথচারীর পারাপার এবং একই রাস্তায় বিভিন্ন গতির যানবাহনের বিশৃঙ্খল চলাচল। </p> <p>এছাড়াও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এসব সমস্যার কারণে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলছে। কার্যকর উদ্যোগ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই অবস্থার কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।</p> <p>এই সমস্যাগুলোর সমাধানে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে প্রয়োজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কার্যকর সমন্বয় এবং দৃঢ় মনোভাব।</p> <p><strong>পরিত্রাণের উপায়</strong></p> <p>ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ 'নগর পরিবহন' সেবা চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলের নিরঙ্কুশ আন্তরিকতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পাইলট প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে।</p> <p>নগর পরিবহনের সকল বাস একই রঙের হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুরোনো জরাজীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নগর পরিবহনে রাখা যাবে না। প্রতিটি গাড়িতে শুধু রুট নম্বর লেখা থাকবে। নগর পরিবহন কর্তৃপক্ষ গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রুট নম্বর এবং সংশ্লিষ্ট বাসস্ট্যান্ডগুলোর নাম নগরবাসীকে জানাবে। বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক এবং প্রশিক্ষিত হেলপার থাকবেন, যারা নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরে দায়িত্ব পালন করবেন। বাস নির্ধারিত স্টপেজে যাত্রী উঠা-নামা করবে; যাত্রী অপেক্ষা করবে বাসের জন্য, তবে বাস অপেক্ষা করবে না। যাত্রী না থাকলেও বাস নির্ধারিত নিয়মে গন্তব্যে পৌঁছাবে।</p> <p>সকল রুটের ভাড়া নির্ধারিত থাকবে এবং ই-টিকেটিং সিস্টেম চালু করা হবে। প্রতিটি বাসস্টপ নির্ধারিত থাকবে এবং সেখানে একজন ইউনিফর্মধারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ ময়লা ফেলার নির্ধারিত বিন থাকবে। এইসব ব্যবস্থার খরচ বহনের জন্য ভাড়ার সাথে যুক্তিসংগত সার্ভিস চার্জ আরোপ করে নগর পরিবহন তহবিল গঠন করা হবে।</p> <p>ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে স্থাপিত স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি কার্যকর করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশিং বাড়ানো এবং তাদের সংখ্যা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা জরুরি। প্রতিটি মোড়ে অন্তত একজন সার্জেন্ট রাখার পাশাপাশি পিক আওয়ারে দ্বিগুণ পুলিশ মোতায়েন করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ ও চাঁদাবাজি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। চালকের কাগজপত্র যাচাই জনসমক্ষে করতে হবে এবং অপরাধ সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াকিটকি সরবরাহ করা প্রয়োজন, যাতে দ্রুত যোগাযোগ সম্ভব হয়।</p> <p>ঢাকার রিকশা ও ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা বিশেষ ব্যবস্থায় বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে প্রায় সাত লাখ রিকশা ও আট লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে, যেগুলোর বেশিরভাগই অবৈধ। এগুলো সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। বড় অঙ্কের নিবন্ধন ফি ও ট্যাক্স নির্ধারণ করে রিকশার সংখ্যা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যদিকে, সিএনজি বা ডিজেলচালিত থ্রিহুইলারের আমদানি শুল্ক ও নিবন্ধন ফি কমিয়ে তা সহজলভ্য করতে হবে।</p> <p>ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে বাইসাইকেল, রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রিকশাভ্যান এবং ঠেলাগাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনে মিনিট্রাক বা পিকআপ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত। ফুটপাত দখলমুক্ত রাখার জন্য সেগুলো থেকে হাট-বাজার উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। প্রতিটি সড়কে লেন মার্কিং এবং সঠিক রোড সাইন থাকতে হবে। নির্ধারিত লেনে গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করতে নিয়ম অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।</p> <p>নগরীর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা জরুরি। রাস্তা খোঁড়ার কাজ রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে এবং প্রতিদিনের কাজ সেদিনই শেষ করতে হবে। রাস্তার নির্মাণ সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি সড়কে ফেলে রাখা যাবে না।</p> <p>ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। নাগরিক সুবিধা বাড়লে জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। তবে এ প্রক্রিয়ায় নগরীতে বসবাসের খরচ বৃদ্ধি পাবে। সিটিকর্পোরেশন ট্যাক্স এবং পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর ফলে জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে। এই খরচের কারণে স্বল্প আয়ের মানুষ শহরতলিতে চলে যেতে পারে।</p> <p>পৃথিবীর বড় শহরগুলোতে এই মডেল কার্যকর হয়েছে। সঠিক নীতিমালা ও দৃঢ় মনোভাব থাকলে ঢাকায়ও এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।</p> <p><strong>লেখক :</strong> শিক্ষক ও লেখক।</p> <p><em>[মতামত লেখকের নিজস্ব। কালের কণ্ঠ অনলাইন বা কালের কণ্ঠ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।]</em></p>