<p style="text-align:justify">১৯ জুলাই, শুক্রবার বিকেল ৪টা। রাজধানীর রায়েরবাগের কদমতলী এলাকা থেকে ছাত্র-জনতার মিছিলে যুক্ত হন রিকশাচালক মো. বাপ্পি (১৯)। মিছিল কিছুদূর যেতেই পুলিশের ছররা গুলি এসে লাগে বাপ্পির শরীর ও চোখে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ে যান রাস্তায়। আহত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় মাতুয়াইলের এক হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে এক দিন পর পাঠানো হয় শেরেবাংলানগরে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে।</p> <p style="text-align:justify"><img alt="অনেকের চোখের ছররা গুলি বের করা যাচ্ছে না" height="92" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/08-09-2024/77889.jpg" style="float:left" width="343" />গতকাল শনিবার দুপুরে হাসপাতালে গেলে কথা হয় বাপ্পির সঙ্গে। তিনি জানান, দুই চোখেই কিছু দেখতে পান না। আবার চোখে দেখতে পাবেন—এ আশাও ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ ছররা গুলি চোখের আইবল ভেদ করে গভীরে পর্যন্ত চলে গেছে।</p> <p style="text-align:justify"> </p> <p style="text-align:justify">বাপ্পি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসক  আশা ছেড়ে দিয়েছেন। আর ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবু হাসপাতালে আছি, যদি একটা চোখ ভালো হয় এই আশায়।’</p> <p style="text-align:justify">জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৪৫২ নম্বর ওয়ার্ডে এনপি ৫১ নম্বর শয্যায় ভর্তি আছেন বাপ্পি। তাঁর গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া। রায়েরবাগ এলাকায় টিনশেড বাসায় ভাড়া থাকতেন মাকে নিয়ে।</p> <p style="text-align:justify">বাপ্পি বলেন, ‘ওই দিন মিছিলে গিয়েছিলাম সরকার পতনের আন্দোলন শুনে। কোনো চাকরি পাওয়ার জন্য না, আর আমি তো ছাত্রও না। এখন ছাত্ররা ক্ষমতায়, এরা যদি আমার জন্য কিছু করে। আর না হলে, কী আর করব। মা যে কয়দিন পারে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ কইরা যা পায়, দিলে খাব, না  হলে না খাইয়া থাকব।’</p> <p style="text-align:justify">বাপ্পির মতো ৪৫২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন আরো তিনজন। তাঁদের দুজন বাঁ চোখ ও একজন ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">রাবার বুলেট ও ছররা গুলিতে বাপ্পির মতো কত মানুষ দৃষ্টি হারিয়েছেন, জানতে হাসপাতাল পরিচালকের রুমে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে দেয়ালে সাঁটানো ছোট কাগজের দিকে। এতে লেখা রয়েছে, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য সরাসরি যোগাযোগ করুন : সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত দ্বিতীয় তলা, রুম নম্বর ২৩৩। দুপুর ২টা ৩০ মিনিট থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত নিচতলা, জরুরি বিভাগ, রুম নম্বর ১৪৬।</p> <p style="text-align:justify">২৩৩ নম্বর কক্ষের প্রবেশমুখের কাছেই টেবিল নিয়ে বসে আছেন একজন ছাত্র। আন্দোলনে আহত রোগীদের তথ্য ফরম পূরণে সাহায্য করছেন তিনি। ফরম পূরণ শেষ করে রোগীকে নিয়ে ২৩৩ নম্বর কক্ষে দায়িত্বরত নার্সের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আসছেন।</p> <p style="text-align:justify">কক্ষে প্রবেশ করে দেখা যায়, ভেতরে দুই চিকিৎসক ও দুজন নার্স রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। কর্তব্যরত নার্স জানান, প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন রোগী আসছেন চোখের চিকিৎসা নিতে। এদের প্রায় সবাই দৃষ্টি হারিয়েছেন। অনেকের চোখের ভেতরে থাকা ছররা গুলি বের করা যাচ্ছে না। অনেকের বের করা গেলেও দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না।</p> <p style="text-align:justify">সদ্য বিদায়ি পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফার কক্ষে প্রবেশ করে জানা যায়, বর্তমানে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী। তিনি জানান, ১৭ জুলাই থেকে গত শনিবার পর্যন্ত এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৯২৯ জন। ভর্তি রোগী ছিল ৭১৮ জন। এদের মধ্যে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ৭১৮ জনের চোখে। কারো কারো একাধিকবার অস্ত্রোপচার হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ বলেন, ‘আন্দোলনে চোখে আঘাত লেগে কতজন দৃষ্টি হারিয়েছেন, এর প্রকৃত সংখ্যা জানা এখনো সম্ভব হয়নি। আমরা ৫৭৩ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে ৩৮২ জন এবং উভয় চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে ১৯ জন। এক চোখের দৃষ্টিস্বল্পতা দেখা দিয়েছে ৪২ জনের। উভয় চোখে সে সমস্যা হয়েছে দুজনের। এক চোখে গুরুতর দৃষ্টিস্বল্পতা ৪২ জনের এবং উভয় চোখের দৃষ্টিস্বল্পতা দেখা দিয়েছে দুজনের। স্বাভাবিক  দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে ২৫ জন, উভয় চোখে ৫৬ জন।’</p> <p style="text-align:justify">বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, সাদা ও কালো অংশ মিলিয়ে পুরো চোখকে বলা হয় আইবল। মণির ভেতরের ছোট অংশে যেখানে প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তা হচ্ছে পিউপিল। আর পিউপিল বাদে বাকি কালো অংশকে বলা হয় কর্নিয়া। এ ছাড়া আছে রেটিনা। চোখের এসব অংশ কোনটা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার ওপর চিকিৎসা নির্ভর করে।</p> <p style="text-align:justify">অধ্যাপক খায়ের আহমেদ বলেন, আইবলে আঘাত পেলে দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি বেশি থাকে। চোখের পাতায় আঘাত লাগলে সাধারণত দৃষ্টিশক্তি হারায় না। গুলি আইবলে বা অল্প গভীরে আটকে গেলে অস্ত্রোপচার করে বের করে অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে শঙ্কামুক্ত করা যায়। তবে বেশি ঢুকে গিয়ে মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে বাঁচানো কঠিন। এসব গুলি বের করা যায় না।</p> <p style="text-align:justify">তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে বর্তমানে ভর্তি আছে ৭৬ জন। এর মধ্যে অস্ত্রোপচারের অপেক্ষমাণ আছেন ৬০ জন। আমাদের সক্ষমতা মাত্র ১০ জনের। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের দ্রুত অস্ত্রোপচার করা না গেলে দৃষ্টি হারানোর শঙ্কা রয়েছে। তাই বিএসএমএমইউ ও ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে বিনা মূল্যে তাদের চোখে অস্ত্রোপচার হবে। সব ব্যবস্থা সরকার থেকে করা হচ্ছে।’</p>