<p>অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। একই সঙ্গে নির্বাচনব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সংস্কারে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।</p> <p>দলগুলো মনে করে, এই সংস্কারগুলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, গণতন্ত্র নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে যাতে স্বৈরাচার সৃষ্টি না হয়, এতে ভূমিকা রাখবে।</p> <p>গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিকেল ৩টা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ধারাবাহিক মতবিনিময়সভায় এসব কথা বলেন দলগুলোর নেতারা। বৈঠকে দলগুলো লিখিত দাবি ও প্রস্তাব দিয়েছে। এ সময় ইসলামিক দলগুলো আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহবানও জানায়।</p> <p>রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানান, সরকারের আপাতত প্রধান দায়িত্ব দুটি। প্রথমত, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা এবং দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে একটি ভয়ভীতিহীন পরিবেশ তৈরি করে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।</p> <p>বৈঠক শেষে যমুনার সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এলডিপি চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সংসদ নির্বাচন—এগুলোর একটা সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করার কথা বলেছি। ছয় মাস পরও হতে পারে, ৯ মাস পরও হতে পারে, নির্বাচন তো হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও ভালো, রাজনৈতিক দলের জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো।’ </p> <p>তিনি বলেন, তবে সংস্কার করার আগে কোনো নির্বাচন কোনো অবস্থায়ই বাঞ্ছনীয় নয়। সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। দেশের মধ্যে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।</p> <p>নির্বাচনের বিষয়ে আপনাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা কী বলেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা এটাই বলেছেন যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে প্রতিটি বিষয়ে। আমি উত্তর দিকে গেলাম, আপনি দক্ষিণ দিকে গেলেন, তা হলে তো দেশের সমস্যার সমাধান হবে না। সবাইকে একটা ঐকমত্যে আসতে হবে।’</p> <p>খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘আমরা ছয় দল একসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমরা প্রত্যেক দল পৃথকভাবে রাষ্ট্র সংস্কারসহ নানা প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা বলেছি, যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তাঁদের দায়িত্ব দুটি। প্রথমত, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা এবং দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে একটি ভয়ভীতিহীন ‍সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে নির্বাচনের আয়োজন।’</p> <p>এলডিপিপ্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ৮৩ দফা প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টাকে দিয়েছেন বলে জানান। এতে দেশে গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের প্রসঙ্গ টেনে অলি আহমদ বলেন, ‘জামায়াতকে যদি ছোট ছোট তুচ্ছ কারণের জন্য তাদের নিবন্ধন বাতিল করা যায়, আমাদের হাজারো ছেলেমেয়েকে হত্যা করার জন্য, ১৫ বছরে কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গুম করার জন্য তাদেরটা (আওয়ামী লীগ) বাতিল কেন হবে না। এটা বাতিল করা প্রয়োজন। না হলে আগামী দিনে স্বৈরাচারের জন্ম বাংলাদেশে হবে।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আজ বৈঠকে সাবধান করে দিয়ে সরকারকে বলেছি, আপনি এখনো বিপদমুক্ত নন। এখনো যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে, যারা হাসিনার পদলেহী ছিল, তারা এখনো চাকরিচ্যুত হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়নি। তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি করলে সমস্যার সমাধান হবে না। দেশের শত্রুদের জেলে নিতে হবে।’</p> <p>বিকেল ৩টায় ছয় ইসলামী দলের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই মতবিনিময়। সভা শেষে ছয় ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। আমরা উনাকে বলেছি যে তিনি একটি যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। নির্বাচন নিয়ে অযথা যেন বিলম্ব না করেন।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর বিলম্ব না করে নির্বাচনে যেতেই তাঁরা আগ্রহী। সেই ধরনের প্রস্তুতি ও আয়োজন তাঁরা করছেন।’</p> <p>ছয়টি ইসলামী দল হচ্ছে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম।</p> <p>এরপর উপদেষ্টা বৈঠক করেন চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করীমের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে। এরপর অলি আহমদের নেতৃত্বে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক হয় প্রধান উপদেষ্টার। এসব বৈঠকে প্রতিটি দল তাদের দলীয় প্যাডে নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি লিখিতভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করে।</p> <p>রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হাসান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন।</p> <p><strong>পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চায় জাপা </strong></p> <p>জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘এ দেশ বা জাতির এমন কিছু বিষয় আছে প্রশাসনে, বিচার বিভাগে ও সংবিধানে, যা সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচিত সরকার এই সংস্কারগুলো সাধারণত করে না। যেমন—সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন বাতিল করা হয়, তা আমরা উল্লেখ করেছি। বিচার বিভাগ সংস্কার করা, সেটিও আমরা বলেছি। তারপর পার্লামেন্ট, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেছি। একই ব্যক্তি যাতে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী না হন এবং কেউ যাতে দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন, তা তুলে ধরেছি।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্যটা যাতে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে আরো উন্নতি হয়, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে আরো সক্রিয় করা হয়—এসব বিষয় আমাদের চেয়ারম্যান আলাপ করেছেন।’</p> <p><strong>দুর্গাপূজায় সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান</strong></p> <p>বৈঠকে ইসলামী দলগুলো দুর্গাপূজা উপলক্ষে মন্দির, পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নেতাদের কাছে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন, যাতে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে। ইসলামী দলগুলোর নেতারা বৈঠকের পর বিষয়টি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের কাছেও তুলে ধরেন।</p> <p>চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, ‘আমরা সুন্দরভাবে যোগ্যদের দিয়ে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে আমরা পরামর্শ দিয়েছি। আমরা বলেছি, এই সব জায়গায় একটা স্বচ্ছ পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন দেওয়া হলে তখন আবার আগের সেই পরিবেশের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। সে জন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, পরিবেশ তৈরি করতে হবে আগে।’</p> <p>চরমোনাই পীর বলেন, ‘আমাদের ৫৩ বছরের বাংলাদেশে যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আছে, সেখানে কালো টাকার দৌরাত্ম্য ও দলীয়করণ হয় পেশিশক্তির মাধ্যমে, আসলে মূলত যারা নাকি যোগ্য, যাদের দেশের প্রতি প্রেম রয়েছে, এই ধরনের ব্যক্তি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায় না।’</p> <p>ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে বর্তমান সংবিধান বাতিল করে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করে নতুন ‘সংবিধানের’ খসড়া তৈরি এবং জাতীয় নির্বাচনের রোড ম্যাপ ঘোষণা করাসহ ১৩ দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তারা গ্রহণযোগ্য্য তদন্ত কমিশন, স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জুলাই গণহত্যার বিচার, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে ব্যক্তি ও সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হলে তাদের রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি রয়েছে তাতে।</p> <p><strong>ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের দাবি</strong></p> <p>খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা যেসব চুক্তি করেছেন, সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে যেগুলো দেশবিরোধী চুক্তি সেগুলো বাতিল করার কথা আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি। একই সঙ্গে আলেমসমাজ, হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীসহ বিরোধী দলগুলোর যে মামলা শেখ হাসিনার সরকার দিয়েছে, সেগুলো আগামী এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহারের একটা টাইমফ্রেমের কথা আমরা বলেছি।’</p> <p>খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে আশুসংস্কারের সাত দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে সরকারব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদের বেশি না থাকা এবং কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় প্রধান পদে না থাকা, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার, প্রশাসনিক, আর্থিক, শিক্ষাব্যবস্থা, কালো কানুনসহ আইনি সংস্কারের প্রস্তাব করেছে ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে খেলাফত মজলিস।</p> <p>বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুইবারের বেশি সময় যাতে না থাকেন, সেই প্রস্তাব তাঁরা দিয়েছেন।</p> <p>মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের তিন শতাধিক মামলা আমরা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছি। ২০১৩, ২০১৬ ও ২০২১ সালের বহু মামলা ও হতাহত রয়েছে। তাদের অনেকের সন্ধানও আমাদের কাছে নেই। আমরা সেই ব্যাপারেও সহযোগিতা চেয়েছি, যেন আমাদের সব শহীদ ও নিখোঁজ মানুষকে নিয়ে একটি সুন্দর প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসতে পারে। সব হত্যাকাণ্ডের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার প্রস্তাবও আমরা দিয়েছি।’ </p> <p>তিনি বলেন, ‘সংবিধানে আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের যে ধারাটি ছিল সেটা বাতিল করেছে, সেটা যেন পুনর্বহাল করা হয়। সংবিধানে এ জন্য সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছি। দেশে নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামবিরোধী নীতি বা আইন যেন না হয়, সে বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়েছি প্রধান উপদেষ্টার কাছে।’</p>