<p>বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী গারো জনগণ, যারা নিজেদের 'মান্দি' (মানুষ) হিসেবে পরিচয় দেন, তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আধ্যাত্মিক উৎসব হল ওয়ানগালা। এটি একটি প্রথাগত উৎসব, যা মূলত নতুন ফসল তোলার পর, বর্ষার শেষে এবং শীতের আগে অনুষ্ঠিত হয়। গারো সম্প্রদায় এই উৎসবের মাধ্যমে তাদের দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়, বিশেষ করে সূর্য দেবতা মিসি সালজংয়ের প্রতি।</p> <p><strong>উৎসবের ধারণা ও উৎসর্গের উদ্দেশ্য</strong></p> <p>গারো ভাষায় 'ওয়ানা' শব্দটির অর্থ হচ্ছে দেব-দেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী এবং 'গালা' শব্দটি উৎসর্গ করা। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবতা মিসি সালজংয়ের নির্দেশে সূর্য বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদগম ঘটান, এবং এভাবেই ফসল পরিপক্ব হয়। তাই নতুন ফসল সংগ্রহের পূর্বে দেবতার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশই এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য।</p> <p><strong>ওয়ানগালা উৎসবের আয়োজন</strong></p> <p>ওয়ানগালা উৎসব শুরু হওয়ার আগে, গারোরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ আচার-অনুষ্ঠান অনুযায়ী একটি সভা আয়োজন করেন, যার মাধ্যমে তারা উৎসবের দিন নির্ধারণ করেন। উৎসবের প্রথম দিনেই, খেতের একটি অংশের ধান কাটা হয় এবং সেটি সূর্য দেবতার উদ্দেশে ধূপ দিয়ে উৎসর্গ করা হয়।</p> <p>প্রথম দিনে বিশেষভাবে দেবতাদের উদ্দেশে নতুন ধানের ভাত, ফলমূল, শাকসবজি এবং পশু-পাখি উৎসর্গ করা হয়। নকমা (গ্রামপ্রধান) ব্যক্তিগতভাবে ঝরনা বা খাল থেকে দুটি কাঁকড়া ধরে আনেন এবং দুপুরের আগে একটি লাল বা সাদা মোরগ নিয়ে আ'সিরকা স্থানে চলে যান। সেখানে সূর্য দেবতার উদ্দেশে মোরগটি উৎসর্গ করা হয় এবং পূজা-অর্চনা সম্পন্ন হয়।</p> <p><strong>ঘরোয়া আচার-অনুষ্ঠান</strong></p> <p>এই বিশেষ দিনগুলিতে, গারোরা তাদের ঘরের মাঝখানে কলাপাতায় নতুন ধানের ভাত এবং অন্যান্য শস্য, কৃষি যন্ত্রপাতি ও বাদ্যযন্ত্র সাজিয়ে রাখেন। এসব শস্য এবং উপকরণ তাদের জীবনযাত্রার প্রতীক এবং জমির ওপর নির্ভরশীলতার প্রতিফলন। এর পর, নকমার বাড়িতে শুরু হয় ওয়ানগালার আনুষ্ঠানিকতা।</p> <p><strong>তিন দিনের অনুষ্ঠান</strong></p> <p>গারোদের ওয়ানগালা উৎসব তিন দিন ধরে চলে। এই তিন দিন জুড়ে গারোরা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে, যেমন উৎসর্গের মাধ্যমে দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে উৎসব উদযাপন করা।</p> <p><strong>এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন</strong></p> <p>ওয়ানগালা শুধু গারোদের ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। একদিকে যেখানে এটি তাদের কৃষিকাজের আনন্দ ও সংগ্রামের ফলস্বরূপ, অন্যদিকে এটি গারো সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অমূল্য অংশ হিসেবে একতাবদ্ধ হতে সাহায্য করে।</p> <p>এ উৎসবের মাধ্যমে গারোরা তাদের জীবনে আধ্যাত্মিকতা এবং প্রাকৃতিক পৃথিবীর প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিফলন ঘটান, যা একটি বৃহত্তর সমাজে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে একটি অমূল্য সংযোগ তৈরি করে।</p>