<p>নিজেদের বাড়ি ভিটার জায়গা ছাড়া কিছুই নেই। ৩ শতাংশ জায়গায় টিনের বেড়া আর টিনের চালা দিয়ে ২টি ঘর। আঙ্গিনায় রান্নাঘর আর এক পাশে ছাগল বাঁধার জায়গা। ঘরের বারান্দায় বাবা শ্যালো মেকানিকের রাখা ভাঙা যন্ত্রপাতি। ভাঙা যন্ত্রপাতি নিয়েই আয়ের জন্য বাবা প্রতিনিয়ত বেরিয়ে যান মানুষের বাড়ি বাড়ি শ্যালো মেশিন আর জমি চাষের পাওয়ার টিলার ঠিক করতে। বাবার আয়েই চলত সংসারের ভরণপোষণ আর দুই ভাইয়ের লেখাপড়া। কলেজ বন্ধের দিনে বাবার সঙ্গে নিজেও কাজ করে টাকা উপার্জন করতেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিহত নজিবুল সরকার বিশাল (২০)। পরিবারের পাশাপাশি নবম শ্রেণিপড়ুয়া ছোটভাই মুমিন সরকারকে ভালো করে মানুষ করার স্বপ্নও ছিল বিশালের। বাবা-মা পরিবার আর ভাইকে প্রতিষ্ঠিত করার সেই স্বপ্ন পাঁজরে লাগা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় শহীদ বিশালের।</p> <p>স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট সকাল ১১টার পর জয়পুরহাট জেলা শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নজিবুল সরকার বিশাল। বিশাল পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জি ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের বাবা মজিদুল সরকার আর মা বুলবুলি খাতুনের বড় সন্তান। পাঁচবিবি বিজনেজ ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল সে। ২০২৩ সালে রতনপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয় বিশাল। ছোট ভাই মুমিন সরকার রতনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র।</p> <p>পুত্র শোকে নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া বাবা-মা বিশালকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। মা বুলবুলি খাতুন বলেন, ‘কতদিন হয়ে গেল বাড়িতে আমার ছেলেটার মুখে জোরে আম্মু ডাকতে শুনতে পাই না। ঘটনার দিন স্থানীয় বাজারে ওষুধ আনার কথা বলে সকালে ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় বিশাল। এরপর দেড় দুই ঘণ্টা পর শুনতে পাই বিশাল জয়পুরহাটে যায়ে গুলি খাইছে। পরে জানছি জয়পুরহাট সদর হাসপাতাল থেকে বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায়।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘মারা যাওয়ার পর ওর বন্ধুদের কাছে জানতে পারি মোবাইলে বন্ধুদের সঙ্গে আগের রাতে গ্রুপে আলোচনা করে গ্রাম থেকে অনেক ছাত্রের সঙ্গে সেও জয়পুরহাটে যায়। আগের দুদিনও আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ঘটনার দিন বিশাল জয়পুরহাট শহরে যাওয়ার সময় অটোগাড়িতে চড়ে দুহাত তুলে বলেছিল আমি যেন আজ শহীদ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারি, আল্লাহ যেন তাই কবুল করে। আমার ছেলে সত্যিই শহীদ হয়ে ফিরে এসেছে, আমি শহীদের মা হয়েছি।’</p> <p>এ সময় কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে বন্ধুদের বলেছিল, আমাদের তো তেমন কিছু নাই আমি যদি শহীদ হয়ে যাই তোরা আমার মা-বাবাকে বলিস যেন একটু পোলাও রান্না করে এতিমখানার ছেলে-মেয়েদের খাওয়ায়। আমার ছেলেটা বলত, আম্মু আমাদের তো তেমন কিছু নাই, এনজিও থেকে লোন নেওয়া আছে আমি ভালো করে কাজ শিখে বিদেশ গিয়ে টাকা পাঠাব যাতে তুমি সব করতে পারো। আর মুমিনকে ভালো করে লেখা পড়া শেখাবে। ওকে ভালো করে মানুষ করতে হবে। আমার বিশালের কত স্বপ্ন ছিল ছোট ভাইকে মানুষ করবে। ওর সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। ছেলের ভালো করে লেখাপড়া আর সংসারের আয় উন্নতি করার জন্য স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা জাকস ফাউন্ডেশন থেকে ৬০ হাজার টাকা, ব্র্যাক থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং সরকারি একটি বাড়ি একটি খামার থেকে ২৫ হাজার টাকা লোন নেওয়া আছে। ছেলে না থাকায় সংসারে অশান্তি আর আয় রোজগার কমে গেলেও এনজিওর কিস্তি ঠিকই দিতে হচ্ছে।’</p> <p>বিশালের বাবা মজিদুল সরকার বলেন, ‘ছেলে মারা যাওয়ার পরে জয়পুরহাট ১৪ বিজিবির পক্ষ থেকে বিজিবির অধিনায়ক তিন লাখ টাকা, আগের এসপি মোহাম্মদ নুর আলম (সদ্য বদলিকৃত) দেড় লাখ টাকা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে এক লাখ, ছেলের কলেজ থেকে ১০ হাজার টাকাসহ স্থানীয় কিছু সহযোগিতা পেয়েছি। সরকারিভাবে নাম-ঠিকানা সব লিখে নিয়ে গেছে, এখনো কিছু পাইনি। বাবা-ছেলে মিলে উপার্জন করে একটা ভালো বাড়ি করার স্বপ্ন ছিল। সেটা আর করা হলো না।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘ছেলে তো শহীদ হয়ে গেছে আক্ষেপ করে কি করব তবে আমার ছেলে হত্যার বিচারকারীদের যেন বিচার হয় এটাই আমার চাওয়া। বড় ছেলের স্বপ্ন ছিল ছোট ভাইকে মানুষ করার সেই চেষ্টাই করে যাব।’</p> <p>বিশালের মা বলেন, ‘আমার ছেলে নাই এতে যেমন খারাপ লাগছে তেমনি শহীদের মা হওয়ায় আমার হাজারো ছেলে তৈরি হয়েছে এটাই আমার ভালো লাগে। আমার ছেলে মারা গেছে সে শহীদ। আমি চাই দেশে যে সরকারই আসুক বর্তমান বা ভবিষ্যতে শুধু আমার ছেলে নয় আবু সাঈদ ,মুগ্ধ সহ যারাই শহীদ হয়েছে তাদেরকে যেন শহীদের মর্যাদা দেয়। আমার ছেলেকে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার হত্যা করেছে তাদের যেন কঠোর থেকে কঠোর বিচার হয় এটাই আমার চাওয়া।’</p> <p>শহীদ বিশালের বাবা মায়ের এনজিও থেকে লোন মওকুফের বিষয়ে ব্র্যাক ও জাকস ফাউন্ডেশনের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি মিললে সেগুলো মওকুফ করা যাবে।</p> <p>সরকারি একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের লোনের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, শহীদ বিশালের পরিবারের লোন মওকুফ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।</p>