<p>মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মুহিবুল ইসলাম আজাদের বিরুদ্ধে পাহাড় সমান অভিযোগ উঠেছে। তাঁর ব্যাপক অনিয়ম ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে পরিষদের সদস্যসহ ইউনিয়নবাসী এখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে ভাগ্য বদলে হয়ে যান লাখ লাখ টাকার মালিক। এমনকি এলাকার সেবাগ্রহিতা নাগরিকদেরও বিভিন্ন সময়ে লাঞ্ছিত, অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনাও বাদ পড়েনি তাঁর হাত থেকে।<br />  <br /> অনুসন্ধান করে জানা গেছে, স্থানীয় রবিরবাজারে স্টেপ ওয়ান ফ্যাশন এবং স্টেপ ওয়ান টেলিকম নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল চেয়ারম্যানের বন্ধু নজরুল ইসলাম কয়েছের। সেখানে যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতেন আজাদ ও তার বন্ধু কয়েছ। ওই দোকানে প্রায় ১২-১৪ বছর আগে তিনি মোবাইল অপারেটরের কাজ করতেন। ওইসময় আজাদের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। কিন্তু গত ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে ভাগ্য বদলে যায় আজাদের। ইউনিয়নের সাধারণ জনগণ অভিযোগ করে বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করে চেয়ারম্যান হয়েই আজাদ এখন সিনেমার নায়কের মতো দামি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করেন। বছর দেড়েক আগে প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নিশান ঝুঁকি ব্রান্ডের একটি গাড়ি কিনেন চেয়ারম্যান আজাদ। </p> <p>এ ছাড়া নিজের ছেলের শখ পূরণের জন্য সম্প্রতি ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছেন। অন্যদিকে চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তাঁর জরাজীর্ণ পাকা ঘর ছিল সেটি এখন আলীশান বাড়িতে রূপান্তর করেছেন।</p> <p>এদিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান আজাদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে তাঁর পদত্যাগের দাবি জানিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে স্থানীয় ছাত্র-জনতা। বিক্ষোভ মিছিল শেষে চেয়ারম্যান আজাদের পদত্যাগ ও কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে তারা চেয়ারম্যানের কার্যালয় তালাবদ্ধ করে রাখে। ওইদিন বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে তাঁর পদত্যাগের দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপিও প্রদান করে। </p> <p>এ ছাড়া সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে চেয়ারম্যান আজাদের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নেটিজেনরা নানা সমালোচনা করেন। যেখানে দেখা যায়, চেয়ারম্যান আজাদ অশ্লীল ভাষায় মাওলানা মামুনুল হককে গালিগালাজ করছেন। </p> <p>এদিকে চেয়ারম্যান আজাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার অসাদচারণ, নৈতিক স্ফলন এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের ৪ এপ্রিল জেলা প্রশাসক বরাবরে পরিষদের ১০ জন সদস্য মাহমুদা আক্তার, রায়না বেগম, নাজমিন নাহার, দিদারুল আলম দিদার, মুজিবুল হক হারুন, আব্দুল কাদির, সিলভেস্টার পাঠাং, হেলাল আহমদ, দরছ মিয়া ও লছমি নারায়ন অলমিক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ এনে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। </p> <p>অভিযোগ হলো- জন্ম নিবন্ধনের অর্থ আত্মসাৎ, সরকারি টিআর, কাবিখা, কাবিটা প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে টাকা আত্মসাৎ, ভূমি হস্তান্তর কর ১% আত্মসাৎ, পরিষদের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই নিজের ইচ্ছেমতো কর্মধা ইউনিয়নে অগ্রণী ব্যাংক ভবনের দোকান কোটা ভাড়া দিয়ে মাসিক ভাড়ার টাকা আত্মসাৎ, সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যদের সঙ্গে অশোভন আচরণ, গৃহকরের টাকা আত্মসাৎ, এলজিএসপি প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে পুরো টাকা কৌশলে আত্মসাৎ, ইউনিয়ন উন্নয়ন সহায়তা তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ, গভীর নলকূপ বরাদ্ধে অনিয়মসহ অসংখ্য দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে ইউপি সদস্যদের হুমকি-ধামকি দিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবের বিষয়টি সমঝোতা করেন।</p> <p>খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, কর্মধা ইউনিয়নে গত তিন বছরে ৯ হাজার ৮০০টি গৃহকর বাবদ প্রায় ৫০ লাখ টাকারও বেশি টাকা চেয়ারম্যান আজাদ আত্মসাৎ করেছেন। জন্ম সনদ, মৃত্যু সনদ, নাগরিক সনদ, বিভিন্ন সনদসহ তিন বছরে প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি টাকা আদায় করা হয়। ইউনিয়নের কাঁঠালতলী বাজারে পরিষদের নিজস্ব মালিকানাধীন ভবন থেকে ১৪ কোটা বিশিষ্ট একটি সেডঘরসহ সেডঘরের বাইরে ২২টি দোকান থেকে মাসিক ভাড়া, নিজস্ব মালিকানাধীন ভবনে অগ্রণী ব্যাংক ও ৫টি দোকান কোটা থেকে প্রতি মাসে ৩২ হাজার টাকা করে তিন বছরে মোট ৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স বাবদ প্রতি বছর ২ লাখ ১৪ হাজার ৫৯০ টাকা করে তিন অর্থ বছরে মোট ৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭০ টাকা উত্তোলন করা হয়। </p> <p>এদিকে চেয়ারম্যান আজাদ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নজরুল ইসলাম কয়েছকে দিয়ে বেআইনিভাবে জন্ম সনদের ফি বাবদ লাখ লাখ টাকা আদায় করেন। এ নিয়ে এলাকার লোকদের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধলে চেয়ারম্যান আজাদ তার বন্ধু কছেয়কে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন এবং সচিব বুরহান উদ্দিনের কাছ থেকে প্রতিদিন জন্ম সনদ ফি বাবদ আদায়কৃত টাকা নিজে গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ করেন। পরবর্তীতে সেই টাকা তৎকালীন ইউপি সচিব মো. বুরহান উদ্দিনের ওপর দায় চাপিয়ে তাকে জোরপূর্বক তালাবদ্ধ করে রাখেন। </p> <p>এ ঘটনায় ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর প্রতিকার চেয়ে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন সচিব বুরহান উদ্দিন। ওই অভিযোগে উল্লেখ ছিল, ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন অংকে মোট ২ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা জন্ম সনদ ফি আদায় করেন চেয়ারম্যানের বন্ধু নজরুল ইসলাম কয়েছ। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আরো লাখ লাখ টাকা জন্ম সনদ বাবদ টাকা আদায় করেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে ইউনিয়নের কর্মধা গ্রামের বাসিন্দা হাসন আলীর ছেলে তাজুল ইসলাম শামীমের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন চেয়ারম্যান আজাদের বাহিনী। পরবর্তীতে শামীমের মা বাদী হয়ে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিআর ২৯৮/২২ইং মামলা দায়ের করেন। ইউনিয়নের দিঘলকান্দি গ্রামের রমজান আলীর ছেলে কলেজছাত্র সাহান মিয়া তার জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন সংক্রান্ত আবেদনে স্বাক্ষর নিতে গেলে টাকা না দেওয়ায় চেয়ারম্যান আজাদ ও তার বন্ধু কয়েছ কলেজছাত্র সাহানকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। </p> <p>কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দায়িত্ব পালনকালে আমি কোনো ঘুষ খাইনি, কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি করিনি। যদি কেউ দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারে তাহলে স্বেচ্ছায় চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করব। দামি গাড়ি কেনা ও বাড়ি তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় গাড়িটি ক্রয় ও পারিবারিক আয়ের টাকা দিয়ে বাড়ি তৈরি করেছি। গৃহকরের টাকা আত্মসাৎ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিবছর ইউনিয়নে মাত্র সাড়ে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা আদায় হয়। সেই টাকা পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সম্মানিসহ উন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়। জন্ম সনদ ফি টাকা আত্মসাৎ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জন্ম সনদের টাকা আদায় করা আমার দায়িত্ব নয়। সেটি সচিবের দায়িত্ব। তৎকালীন সচিবের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক ভালো না থাকায় ইউনিয়নের সার্বিক বিষয় ও জনগণকে কন্ট্রোল করার জন্য আমার বন্ধু কয়েছকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম।  </p> <p>উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তদন্তক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। </p>