<p>ময়মনসিংহ-১০ গফরগাঁও আসনের তিনবারের জাতীয় সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ ওরফে বাবেল গোলন্দাজ যদি মনে করতেন কেউ তাঁর বিরোধিতা করছে, তাহলেই শাস্তি দিতেন। কখনো গাছের ডালে উল্টো করে ঝোলানো, কখনো নিজের বাসার পাশে পুকুরের পানিতে চোবানো কিংবা পোষা কুকুরের খাঁচায় পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিতেন। তাঁর এই টর্চার সেল খ্যাত আলিশান বাড়িটি গত ৬ সেপ্টেম্বর ভোরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে জনতা।</p> <p>নির্যাতন ছাড়াও দখলবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, মনোনয়ন বাণিজ্য, বিরোধী দল দমন, টেন্ডার সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা বাবেল এবং তাঁর বাহিনি করেনি।</p> <p>মতের বাইরে গেলেই বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট কিংবা জমি-সম্পদ দখল তো ছিল মামুলি ব্যাপার। তিনি বাসার ভেতরে লোহার খাঁচায় বিশালদেহী দুটি কুকুর পুষতেন।  বিরোধিতাকারীদের নির্যাতনের জন্য এই খাঁচায়ও ঢুকিয়ে দিতেন বলে অভিযোগ আছে। বাবা আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ এমপির মৃত্যুর পর ২০১৪ সালে বাবেল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন।</p> <p>এরপর বিরোধী দল তো বটেই, নিজের দলের নেতাদেরও কোণঠাসা করে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। যারা বাবেলের কথা শোনেনি তারা গফরগাঁও ছাড়তে বাধ্য হয়।</p> <p>গফরগাঁওয়ে গত চার দিন ঘুরে কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কারো কারো শরীরে কুকুরের আঁচড় ও কামড়ের দাগ এখনো রয়েছে। এভাবে নির্যাতিতদের মধ্যে এমপি বাবেলের গাড়িচালক রাসেলও রয়েছেন।</p> <p>স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল মান্নান পল্টন জানান, চরের বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ করায় তাঁকে ধরে নিয়ে বাবেলের বাড়িতেই আটকে চালানো হয় নির্যাতন। ধামাইল মহল্লার বাসিন্দা কাঠমিস্ত্রি মানিক মিয়া জানান, বিভিন্ন সময় বাবেল এমপির বাসায় কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন অত্যাচারের দৃশ্য। বিশেষ করে কুকুরের খাঁচায় মানুষ ঢুকিয়ে নির্যাতনের দৃশ্য ভোলার নয়।</p> <p>গফরগাঁও পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মাহবুবুল ইসলাম ইমন। ২০২২ সালের ২৪ মে তাঁর ওপর হামলা চালায় বাবেলের সন্ত্রাসী গ্রুপ।</p> <p>ইমন জানান, তাজমুনের নেতৃত্বে টিপু, অনিক, জুনাঈদ, তারাসহ একটি সশস্ত্র দল তাঁকে স্টিলের পাইপ দিয়ে মারধর এবং পায়ে গুলি করে। এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। গত দুই বছরে এর বিচারও চাইতে পারেননি।</p> <p>অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় পৌর বিএনপির সদস্য অলিউল্লাহ খন্দকার সুশানের ওপর বছর দশেক আগে হামলা চালায় বাবেলের সন্ত্রাসীরা। দুই পা ও মাথায় ব্যাপক আঘাতে অচেতন হয়ে পড়লে তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায় তারা।</p> <p>এ ছাড়া বাবেলের অত্যাচারের শিকার পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাবুল হোসেন, সাবেক পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট কায়সার আহম্মদ ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক ফজলুল হক। বাড়িঘর ভাঙচুর ও একাধিকবার লুটপাটের শিকার আব্দুস সালাম, জাহিদ হাসান সুমন, গফুর হাসান, আবু সায়েম, আল-আমীন জনি, মহিউদ্দিন সুমন ও সুশান।</p> <p><strong>টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও বালু সিন্ডিকেট</strong></p> <p>বাইরের ঠিকাদার গফরগাঁও এসে কোনো কাজের শিডিউল কিনতে পারতেন না। নিজের লোকজনকে দিয়ে নামে-বেনামে শিডিউল কেনাতেন বাবেল। বাইরের কোনো ঠিকাদার এলে আগেই বাবেলকে শতকরা ১০ ভাগ দিয়ে কাজে হাত দিতে হতো। গত ১০ বছরে যত উন্নয়নকাজ হয়েছে, তা থেকে বাবেল প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে প্রচার রয়েছে।</p> <p>জানা যায়, প্রতিদিন শতাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা গফরগাঁও থেকে ময়মনসিংহে চলাচল করে। এসবের আয় থেকে শতকরা ৪০ টাকা নিতেন বাবেল। আবার ত্রিশালের ধলা থেকে টোক পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার ও টোক থেকে ত্রিমোহনী পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারজুড়ে নদীর বালু উত্তোলন করত বাবেলের সিন্ডিকেট। সাতটি ভাগে ভাগ করে প্রতি ভাগে দেড় কোটি টাকা করে ইজারা দেওয়া হয়েছে, ওই টাকা গেছে বাবেলের পকেটে।</p> <p><strong>মনোনয়ন ও নিয়োগ বাণিজ্য</strong></p> <p>কথিত আছে, ২০১৯ সালে উপজেলা নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়ে তিন কোটি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এক থেকে দেড় কোটি, সদস্য পদে পাঁচ লাখ ও কাউন্সিলর পদে ১০ লাখ টাকা করে নিয়ে তাঁদের নির্বাচিত করে এনেছেন। উপজেলায় ১৫টি ইউনিয়নে গত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ১২ জন। একটি ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী দিয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছ থেকে এক কোটি টাকা নিয়ে তাঁকে জিতিয়ে এনেছেন বলেও অভিযোগ আছে।</p> <p>উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছিল বাবেলের নিয়োগ বাণিজ্য। ১৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি নিয়োগেও প্রতিজনের কাছ থেকে নিয়েছেন সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে। প্রতি শিক্ষকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে আট থেকে দশ লাখ টাকা। এভাবেই গত ১০ বছরে প্রায় ২৫ কোটি টাকা আয় করেন তিনি।</p> <p><strong>১০ বছরে কমপক্ষে ১২ জন নিহত</strong></p> <p>২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এমপি থাকাকালে বাবেল গোলন্দাজের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে নিহত হন কমপক্ষে ১২ জন। বিএনপি সমর্থিত ছাড়াও নিজ দল আওয়ামী লীগের অনেকেই খুন হন। তাঁদের মধ্যে ইবনে আজাদ কমল, মানসুর আহম্মেদ, মাওলানা সিরাজুল হক, শাকিল আহম্মেদ, জয়নাল, ডাক্তার হারুন ও নুরুল হক খানের নাম উল্লেখযোগ্য।</p>