<p>নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের খাদুন এলাকায় রূপসী গাজী টায়ারস কারখানার ভেতরে মালপত্র লুট করতে গিয়ে তিন যুবক এক যুবককে গলা কেটে হত্যা এবং কয়েকজনকে কুপিয়ে জখম করেন। উপজেলার বরাব এলাকার ওই তিন যুবক ঘটনাটি ধাপাচাপা দিতে কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর তাঁরা কারখানা ভবনের শাটার নামিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা সংস্থা, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।</p> <p>কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২৪ আগস্ট সন্ধ্যায় বরাব এলাকার সহিদুল ওরফে ডাকাত সহিদ, শ্যুটার শাকিল, মিজানসহ কয়েকজন খাদুন এলাকায় যান। এ সময় তাঁদের বাধা দেন খাদুনের বাবু মিয়া। এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।</p> <p>বাবু গ্রুপের তাড়া খেয়ে সহিদ গ্রুপ পালিয়ে যায়। রাত ৯টার দিকে খাদুনসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন গাজী টায়ারস কারখানায় লুটপাট করার জন্য ঢোকে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে সহিদ, শাকিল ও মিজান চনপাড়া পুনর্বাসনকেন্দ্রের ভাড়াটে সন্ত্রাসী নিয়ে কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে মহাসড়ক দিয়ে এসে কারখানায় ঢোকেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, সহিদদের হুমকি দিয়ে এলাকা ছেড়ে যেতে বলেন বাবু।</p> <p>কিন্তু সহিদ ও তাঁর লোকজন আবার সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় সহিদ ধারালো অস্ত্র দিয়ে একজনকে গলা কেটে হত্যা করেন। এ সময় কয়েকজনকে কুপিয়ে জখম করেন সহিদ ও তাঁর লোকজন। নাম না প্রকাশের শর্তে একজন বলেন, ঘটনার পর সহিদ লোকজনকে ৫ ও ৬ তলায় টায়ার ও তারের কয়েল আছে বলে ওপরে পাঠান। লোকজন ওপরে চলে গেলে তাঁরা (সহিদ) হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে নিচতলায় থাকা রাসায়নিকে আগুন ধরিয়ে দেন। পরে তাঁরা শাটার লাগিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা গেছে, সহিদ আন্ত জেলা ডাকাতদলের সদস্য। তাঁর বাড়ি তারাব পৌর এলাকায়। তাঁর বিরুদ্ধে স্কুলছাত্রী প্রিয়াংকা হত্যা মামলাসহ  ১৮টি মামলা রয়েছে। আর মিজানের বাড়ি বরাব এলাকায়। তিনি ফেনসিডিলের পাইকারি বিক্রেতা। তাঁর বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা রয়েছে। শ্যুটার শাকিলের বাড়ি বরাব এলাকায়। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনসহ আটটি মামলা রয়েছে।</p> <p>এলাকাবাসী জানায়, সহিদ-শাকিল-মিজানদের কাজই হলো কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে ডাকাতি করা। তাঁরা মানুষজনকে নানা নির্যাতন করেও বেড়ান। তাঁদের অত্যাচারে তারাব পৌরবাসী অতিষ্ঠ। স্থানীয়রা বলে, যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন তাঁরা সে দলের বনে যান। গত ৫ আগস্টের আগে তাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাঁরা এখন বিএনপির নেতা বনে গেছেন।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২৩ আগস্ট রাতে রূপসী গাজী টায়ারস কারখানার মালিক গোলাম দস্তগীর গাজী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন। ২৪ আগস্ট তাঁর ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এদিন গাজী টায়ারস কারখানার পাশে খাদুন এলাকা খাপাড়া জামে মসজিদ থেকে ঘোষণায় বলা হয়, গাজী টায়ারস কারখানার ভেতরে যাঁদের জমি জোর করে দখলে নেওয়া হয়েছে তাঁদের নিয়ে বিকেলে রূপসী বাসস্টেশন এলাকায় মিটিং হবে। পরে বিকেল ৪টার দিকে খাদুনের বাবু, তুষার, রবিন, আলামিন, রায়হান, ফোরকান, গোফরানসহ তাঁদের লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কারখানায় লুটপাট শুরু করে। পরে বরাবোর সহিদ ও মিজান তাঁদের লোকজন নিয়ে দেশীয় অস্ত্রসহ কারখানায় ঢুকে লুটপাট শুরু করে। খবর পেয়ে চনপাড়া থেকে আরেকটি গ্রুপ এবং রূপগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন কারখানায় গিয়ে লুটপাট চালাতে থাকেন। পরে খাদুনের খাপাড়া মসজিদ থেকে দ্বিতীয়বার ঘোষণায় গাজী টায়ারস কারখানায় ডাকাত ঢুকেছে বলে এলাকাবাসীকে প্রতিহত করতে এবং সাধারণ মানুষকে কারখানা থেকে বের হয়ে যেতে বলা হয়।</p> <p>এদিকে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে লুটপাট নিয়ে ছয়তলা ভবনটির নিচতলায় বাবু, তুষার, জনি, রবিন, আলামিন, রায়হান গ্রুপ, সহিদ-মিজান গ্রুপ ও চনপাড়ার একটি গ্রুপের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এতে সাধারণ মানুষসহ ১৫ থেকে ২০ জন গুরুতর আহত হয়। সংঘর্ষের মধ্যে একজন নিহত হয় ও আহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে নিজেদের সংঘর্ষ ও লুটপাটের ঘটনা আড়াল করতে বাবু ও সহিদ গ্রুপ লুটপাট করতে আসা লোকজনকে ভবনের চার ও পাঁচতলায় অনেক তামা ও দামি কেমিক্যাল রয়েছে বলে ওপরে উঠতে বলে। পরে তাঁরা ভবনের নিচতলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেটের সাটারে তালা ঝুলিয়ে চলে যান।</p> <p><strong>গণশুনানি, সড়ক অবরোধ, হাড়-খুলি উদ্ধার</strong></p> <p>এদিকে রূপসী গাজী টায়ারসে আগুনের ঘটনায় গঠিত আট সদস্যের তদন্ত কমিটি তদন্তের অংশ হিসেবে গতকাল সকাল ১১টায় গণশুনানি শুরু করে। কারখানার প্রধান ফটকে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে আট সদস্যের উপস্থিতিতে গণশুনানিতে প্রত্যক্ষদর্শী, এলাকাবাসী ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা অংশ নেয়। কমিটির কাছে প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী ঘটনার বর্ণনা দেয়। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গণশুনানি চলাকালে ভবন দেখার দাবি জানিয়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা প্রায় ২০ মিনিট ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও রূপগঞ্জ ইউএনও আশ্বাস দিলে তাঁরা অবরোধ তুলে নেয়। দুপুর ২টার পর গণশুনানি সমাপ্তি ঘোষণা করে কর্মকর্তারা চলে গেলে বিক্ষুব্ধ স্বজনরা ভবনের ভেতরে ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে হাড়-খুলি উদ্ধার করেন। এক পর্যায়ে তাঁরা আবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধসহ টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে প্রশাসনের আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেন।  </p> <p>তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, গাজী টায়ারস কারখানায় ঘটনার দিন কী ঘটেছিল, লুটপাট ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় কারা জড়িত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের নামের তালিকা যাচাই-বাছাই করতে এই গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও এলাকাবাসীর দেওয়া জবানবন্দি যাচাই-বাছাই করে সঠিক ঘটনা প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে। সকালে গণশুনানিতে নিখোঁজ হওয়া ৮০ জনের স্বজনরা অংশ নেয়।</p> <p>নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান গণশুনানি শেষে সাংবাদিকদের বলেন, সব যাচাই-বাছাই করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। দ্বিতীয় দফায় কবে গণশুনানি শুরু হবে, সেটা পরে জানানো হবে।</p> <p>গত ২৭ আগস্ট জেলা প্রশাসন আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে।</p>