<p>ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকের শৈশব কেটেছে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায়। ২৬ বছর আগে সেখানে বেড়ে ওঠেন মানিক। গ্রামের বাড়ি গাজীপুর থেকে ঢাকায় এসে যখন মাথা গোঁজার ঠাঁই পাচ্ছিলেন না, তখন ওই এতিমখানায় থাকার সুযোগ পান মানিক। সেখানে থাকা অবস্থাতেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।</p> <p>স্থানীয় এক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় মানিকের ডালপালা মেলতে থাকে। তবে ২০১৫ সালে সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সেই থেকে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে বাড়তে থাকে তাঁর সম্পদ। এক পর্যায়ে জাতীয় নির্বাচনেও তাঁকে প্রার্থী হতে দেখা গেছে।</p> <p>রাজধানীতে মানিকের মতো অন্তত এক ডজন কাউন্সিলর রয়েছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যাঁরা বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই কাউন্সিলররা বেশির ভাগ বর্তমানে আত্মগোপনে, কেউ বা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে।</p> <p>সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার একজন নিরাপত্তাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় তিন যুগ ধরে এই এতিমখানায় আছি। ২৬ বছর আগে মানিককে এই এতিমখানায় বড় হতে দেখেছি। পরে রাজনীতিতে ঢুকে আমাদের আর চিনত না।’</p> <p>কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি ও লালবাগ থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজধানীর লালবাগে দখল-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে অন্যতম আজিমপুর বাস টার্মিনাল থেকে মাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি। আওয়ামী সরকার পতনের পর ছাত্র হত্যার মামলায় গ্রেপ্তার মানিক দুইবার রিমান্ডের পর বর্তমানে কারাগারে।</p> <p><strong>কামরাঙ্গীর চরের আতঙ্ক ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন</strong></p> <p>ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার আগে-পরে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে চাঁদাবাজি, জমি দখল থেকে শুরু করে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষ থেকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও হোসেন ও তাঁর বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাননি। বর্তমানে এলাকায় কাউন্সিলর হোসেনের নানা অপকর্মের কথা মানুষের মুখে মুখে। তাঁর ক্যাডার বাহিনীর অনেক সদস্য মাদক কারবারে জড়িত। এলাকার বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, অবৈধ ইঞ্জিনচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণ করত এই বাহিনী। কাউন্সিলরের অন্যতম সহযোগী ইসমাইল হোসেন ওরফে মাউরা ইসমাইল অবৈধ গ্যাস সংযোগের অন্যতম হোতা। সংযোগপ্রতি সে আদায় করত ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হোসেন কাউন্সিলরের মতো তাঁর সহযোগীরা বর্তমানে গাঢাকা দিয়েছে।</p> <p><strong>কাউন্সিলর আনিসুরের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই</strong></p> <p>ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বনশ্রী-গোড়ান এলাকায় ঝিল ভরাট করে দখল, অন্যের জায়গা দখল, সন্ত্রাসী বাহিনী লালন, মাদক ব্যবসা, কিশোর গ্যাং পালনের মতো অভিযোগ থাকলেও ২০২০ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে বিজয়ী হন। শূন্য থেকে রাজনীতিতে আসা আনিসুর কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাঁর বাহিনীর অনুমতি ছাড়া নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করা যেত না। স্থানীয়রা জানায়, কাউন্সিলর হওয়ার পর শতকোটি টাকার মালিক বনে যান আনিসুর।</p> <p><strong>বেপরোয়া ছিলেন কাউন্সিলর রতন</strong></p> <p>ঢাকা দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন রতন টাকার গন্ধ ভালোই চিনেছিলেন। যেখানে টাকার গন্ধ, সেখানেই কাউন্সিলর রতন। এলাকার বাসিন্দাদের ভালো-মন্দে তাঁর কিছুই আসত না। টাকা পেলে তিনি সব কিছু করতেন। সম্পদের পাহাড় গড়তে দখলবাজি, চাঁদাবাজি, ক্যাসিনো জুয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছিলেন রতন। ক্যাসিনোকাণ্ডসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানও করেছে। দুদকের অনুসন্ধানেও উঠে আসে কাউন্সিলর রতনের চাঁদাবাজি, ক্যাসিনো ব্যবসা, দুর্নীতি আর অবৈধ সম্পদ এবং বিদেশে অর্থপাচারের মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত। শুধু সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটে নকশাবহির্ভূত দোকান বানিয়ে বিক্রি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত শতকোটি টাকা। এক মাস ধরে তাঁর হদিস নেই।</p> <p><strong>টাকাই নেশা ছিল কাউন্সিলর রাষ্টনের</strong></p> <p>ঢাকা উত্তর সিটির ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম রাষ্টন। তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ করা জমি দখল, ফুটপাতের দোকান, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও আবাসিক হোটেল থেকে মাসে অন্তত ৫০-৬০ লাখ টাকার চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বিহারি ক্যাম্পে প্রতিদিন অন্তত ২৫-৩০ লাখ টাকার মাদক বিক্রির টাকা থেকে প্রতি সপ্তাহে ১০ লাখ টাকা নিতেন কাউন্সিলর রাষ্টন। বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা তোলা ও মাদক বিক্রির টাকা সংগ্রহ, নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা আলাদা লোক নিয়োগ করেছিলেন তিনি। তথ্য আনা-নেওয়া ও হামলা চালাতে গড়ে তুলেছিলেন কিশোর গ্যাং। কাউন্সিলর থাকা অবস্থায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক কারবারের কমিশন নিয়ে স্বল্প সময়ে বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। নিজের নামের পাশাপাশি স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের নামে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদ। এলাকায় কেউ বাড়ি বা কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাইলে তাঁকে চাঁদা দিতে হতো।</p> <p>এই কাউন্সিলররা ছাড়াও বর্তমানে উত্তর সিটির অন্তত এক ডজন ক্ষমতাধর কাউন্সিলর গাঢাকা দিয়ে আছেন। এর মধ্যে ফরিদ উদ্দিন রতন, মুরাদ হোসেন, মাসুম গণি তাপস, শফিউল্লাহ শফি, ফোরকান হোসেন, আনিসুর রহমান নাইম প্রমুখ।</p>