<p>যদি নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার মৌলিক গঠন ও ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে ইসলামী সভ্যতার ওপর। ইসলামী সভ্যতার রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোই ক্ষণে ক্ষণে প্রতিফলিত হয় আজকের বিশ্বে। যেমন—ন্যায়বিচার, সামাজিক কল্যাণ, ধর্মীয় স্বাধীনতা, রাজনৈতিক নীতি, অর্থনৈতিক নীতিমালা ইত্যাদি। কিন্তু সাড়ে চৌদ্দ শ বছর আগে ইসলামী সভ্যতা যেই আদর্শিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, তা আজকের একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বেও যেন সুদূরপরাহত।</p> <p>প্রগতিশীলতার নামে জাহেলিয়াতের দিকে ক্রম ধাবমান বর্তমান বিশ্ব। পশ্চিমা বিশ্ব আজ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন, যা তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করছে। বস্তুবাদী দর্শন, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, ভোগবাদী জীবনধারা, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও মানবতাবাদের ফাঁকা বুলিতে আজ নুব্জ পৃথিবী। সর্বত্র অবক্ষয় আর ঘোর অমানিশা। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো—</p> <p>১. IMF-এর ২০২০ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে বৈশ্বিক সম্পদের ৫০ শতাংশ সম্পদের মালিকানা ২ শতাংশ জনসংখ্যার কাছে কেন্দ্রীভূত। (IMF : ‘World Economic Outlook’ 2000)</p> <p>অথচ প্রায় ২.৩ বিলিয়ন মানুষ- অর্থাৎ বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ পুষ্টিহীনতার শিকার। (WHO :  ‘Nutrition’ 2023)</p> <p>২. ২০২১ সালে, UNODC রিপোর্ট করেছে যে প্রায় ২৮০ মিলিয়ন মানুষ বিশ্বব্যাপী মাদক ব্যবহার করছে এবং প্রায় ৭০ হাজার মানুষ মাদক ব্যবহারের কারণে মারা গেছে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। (UNOD :  World Drug Report 2021)</p> <p>৩. শুধু পুঁজিবাদী অস্ত্র ব্যবসায়ীদের মুনাফা পৌঁছে দিতে পৃথিবীর কোনায় কোনায় হচ্ছে গৃহযুদ্ধ, শরণার্থী হিসেবে দেশের বাইরে পশুর মত জীবন যাপন করছে প্রায় ৩২০ মিলিয়ন শরণার্থী। (UNHCR : Global Trends Report 2022) </p> <p>অধুনা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধে নিহত হয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার গাজাবাসী, আহত হয়েছে লক্ষাধিক।</p> <p>৪. বর্তমান পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে গড়ে একজন এবং বছরে ৭০ লাখ মানুষ শুধু হতাশায় আত্মহত্যা করে। (WHO)</p> <p>৫. প্রতি মাসেই ডিপ ওয়েব, ডার্ক ওয়েবে আপলোড দেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার জিবি চাইল্ড পর্ন, রেপ ভিডিও, কিলিং-টর্চার ভিডিও’ এমনকি হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টের ভিডিওসমূহ। প্রতিবছর ৩৭ মিলিয়ন ডলারের বিজনেস এই পর্ন ইন্ডাস্ট্রি। (Statista, 2021)</p> <p>৬. ভারতে গড়ে প্রতিবছর হিন্দুত্ববাদীদের হাতে প্রায় ১৫.৬ মিলিয়ন মেয়ে শিশুর ভ্রূণ দুনিয়ার আলো না দেখেই চলে যায়। বিশ্বে প্রায় ৩.৫ থেকে ৪.৫ শতাংশ। ‘Abortion in India : A Global Perspective)’</p> <p>৭. মাদকাসক্তি, পরকীয়া, পর্নাসক্তি, মিলনে অক্ষমতা’- এ রকম অসংখ্য-অজানা ফ্যাক্টর’ এর কারণে প্রতিনিয়ত ভেঙে যাচ্ছে গড়ে ৩৫-৫০ শতাংশ পরিবার, বাড়ছে সংসারে-অশান্তি। ধ্বংসের মুখে আজ আমাদের সমাজব্যবস্থা। (Divorce Rates Around the World)</p> <p>৮. যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩০ মিলিয়ন পুরুষ Erectile Dysfunction-এ আক্রান্ত। এর বাণিজ্য পৌঁছেছে প্রতিবছর ৪২৫ কোটি ডলারে। (AUA : Erectile Dysfunction guideline)</p> <p>৯. গ্লোবালভাবে নারীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ (প্রায় প্রতি তিনজনে একজন) কোনো একসময় যৌন সহিংসতার শিকার হন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় এক লাখ ১০ হাজারেরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। (WHO: Violence against women prevalence estimates 2021)</p> <p>বর্তমান বিশ্বের অবক্ষয়ের কারণ</p> <p>ইসলামী সভ্যতার মডেলের ওপর দাঁড়িয়ে একটি সমৃদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেও আজকের বিশ্বে এই পরিমাণ অবক্ষয়ের কারণ হলো, এনলাইটেনমেন্ট থেকে উৎসারিত হিউমেনিজম ধর্ম, বস্তুবাদী দর্শন, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, ভোগবাদী জীবনধারা, সেক্যুলার সমাজ-রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত পাশ্চাত্য সভ্যতা। যার অন্যতম ভিত্তি ছিল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।</p> <p>মানুষের লক্ষ্য যখন নিরেট বস্তুগত স্বার্থে হয় এবং কোনো উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যবস্থা বর্তমান না থাকে, তখন মানুষ নিরেট বস্তুগত স্বার্থও লাভ করতে পারে না। অর্নল্ড টয়েনবি সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা স্বীকার করে বলেন, এ কথা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে যদি শুধু পার্থিব সুখ-আনন্দকেই জীবনের উদ্দেশ্য বানানো হয় তবে তাতে ব্যক্তির বস্তুগত সুখ এবং পার্থিব শান্তি লাভও অসম্ভব। (Arnold j. Toynbee, Christianity amony the religions of the world)</p> <p>ইসলাম ও বর্তমান বিশ্ব</p> <p>স্যামুয়েল হান্টিংটন ১৯৯৩ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নালে ‘ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশনস’ নামক নিবন্ধ প্রকাশ করে বলেন, আগামী পৃথিবীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ বা অর্থনৈতিক কারণে হবে না; বরং এর কারণ হবে সংস্কৃতি ও ধর্ম। তিনি বর্তমান পৃথিবীকে আটটি সভ্যতায় বিভক্ত করে দেখিয়েছেন, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার আমূল বিনাশী প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলাম।</p> <p>কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব বর্তমান পৃথিবীর নেতৃত্ব, নব্য সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের সবচেয়ে বেশি আয় করা ট্রিলিয়ন ডলারের বিজনেসগুলো ইসলামের হাতে এত সহজেই ধ্বংস হয়ে যেতে দেবে? কখনোই নয়। তাই নিজেদের রক্ষায় ইসলামের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে অন্তত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে পশ্চিমারা। ছড়িয়ে দিচ্ছে ইসলামোফোবিয়া এবং উসকে দিচ্ছে মুসলিমদের জাতিগত দ্বন্দ্ব।</p> <p>ইসলামী নেতৃত্বের যুগ সন্ধিক্ষণ</p> <p>ক্রমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ছুটে যাচ্ছে বুড়ো পশ্চিমা সভ্যতা। খসে পড়ছে তার প্রগতিশীলতার খোলস। বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও নারী অধিকার ইত্যাদি স্বার্থবাদী প্রচারণা। সম্প্রতি গাজা-যুদ্ধ বিশ্ববাসীকে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তাই নিদারুণ বাস্তবতার সম্মুখীন বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা চাতক পাখির ন্যায় উন্মুখ হয়ে আছে একটি নতুন সভ্যতার। যেটি বস্তাপচা পশ্চিমা সভ্যতার অচলায়তন ভেঙে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব গ্রহণ করবে। আর সেই সঞ্জীবনী শক্তি-সামর্থ্য ও স্পৃহা আছে একমাত্র ইসলামী সভ্যতায়। </p> <p>মুসলিম বিশ্বের সার্বিক উন্নয়ন ও শক্তি নিশ্চিত করতে হলে ইসলামী বিধান কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে গোটা মুসলিম বিশ্ব এক বিরাট উম্মায় পরিণত হবে। ফলে একটি যৌথ কৌশলের আওতায় পাশ্চাত্য জগৎসহ অন্যান্য শক্তির যাবতীয় ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।</p>