<p>কবিতার প্রতি আরবদের আকর্ষণ যেন তাদের সত্তার সঙ্গে মিশে আছে। আরবরা সত্তাগত কাব্যপ্রতিভা নিয়ে জন্মাত। তারা প্রকৃতির কোলে-পিঠে বেদুইনের জীবন যাপন করত। আরবের বিচিত্র ও রহস্যময় প্রকৃতি তাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখত। আরবের পরিবেশ ও প্রকৃতি এবং বেদুইন জীবনের মুক্তধারা কবিদের কাব্যচর্চায় ‘সোনায় সোহাগা’ তুল্য ছিল। আরব বেদুইন কবিদের ভাষা ছিল খুব মিষ্ট, চিন্তা-ভাবনা ছিল সরল ও অকৃত্রিম, বাক্য ছিল সুগঠিত। কবির পরম মমতা তাতে জাদুময়তা সৃষ্টি করত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের সময় আরবি কবিতা তার স্বর্ণযুগে পদার্পণ করে।</p> <p>সাহিত্যের সব মানদণ্ডে উত্তীর্ণ কোরআন নাজিল হলে কবিদের ওপর তার প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। একদিকে তারা না পারছিল কোরআনকে অস্বীকার করতে, অন্যদিকে তারা আত্মগরিমার কারণে না পারছিল কোরআনের ওপর ঈমান আনতে। আবার কোনো কোনো কবি সত্যের ছায়াতলে আশ্রয়ও নেয়। </p> <p><strong>জাহেলি যুগে কবি ও কবিতা</strong></p> <p>আরবে ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগে কবি ও কবিতার বিশেষ মর্যাদা ছিল। যখন কোনো কবি কাব্যচর্চায় দক্ষতা ও স্বীকৃতি অর্জন করত, তখন চারদিকে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ত, আনন্দ-উৎসব হতো, বন্ধু ও আপনজনরা তাকে অভিনন্দন জানাত। তাদের এই উৎসবের কারণ ছিল—একজন কবি তার গোত্রের মর্যাদা বৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রাখত, বরং তার কবিতা ছিল তাদের সম্মান রক্ষার হাতিয়ার। একটি কবিতা কখনো একজন ব্যক্তি বা একটি গোত্রকে অমরত্ব উপহার দিত। প্রসিদ্ধ লেখক আবুল ফারাজ ইস্পাহানি (রহ.) তাঁর ‘আগানি’ নামক বইয়ে লিখেছেন, জাহেলি যুগে আরব সমাজে কবিদের প্রভাব সম্পর্কে নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে ধারণা পাওয়া যায়। মুহাল্লিক নামের একজন দরিদ্র্য ও অসহায় ব্যক্তি ছিল।</p> <p>চরম দারিদ্র্যের কারণে সে নিজের তিন মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিল না। ঘটনাচক্রে কবি আ’শা তার এলাকায় উপস্থিত হলো। মুহাল্লিকের স্ত্রী সংবাদ পেয়ে স্বামীকে বলল, কবি আ’শা, যার প্রশংসা করে সে আরবে বিখ্যাত হয়ে যায়। মুহাল্লিক সুযোগটাকে কাজে লাগাতে কবিকে নিজ বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাল। তার জন্য উত্তম খাবার ও মদের ব্যবস্থা করল। আ’শা পরিবারের খোঁজখবর জানতে চাইলে মেয়েদের নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কথা জানাল।</p> <p>কবি বলল, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তাদের জন্য ভাবব। পরবর্তী সময়ে আরবের বিখ্যাত উকাজ মেলায় মুহাল্লিকের উচ্চ প্রসংশা করে কবি আ’শা কবিতা পাঠ করল। কবিতায় মুহাল্লিকের দানশীলতা ও আতিথেয়তার প্রশংসা করে অত্যন্ত আলংকারিক ভাষায় কবিতা রচনা করল। এই কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরবের উঁচু মর্যাদাশীল ও নেতৃস্থানীয়দের থেকে মুহাল্লিকের মেয়েদের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে লাগল। এক সপ্তাহের মধ্যে বংশীয় ঘরে তার সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। (কিতাবুল আগানি)</p> <p><strong>কবিদের ওপর কোরআন নাজিলের প্রভাব</strong></p> <p>এমন অবস্থায় যখন মহানবী (সা.) আগমন করেন এবং আরবরা তাঁর কণ্ঠে কোরআনের তিলাওয়াত শোনে, তখন তারা কোরআনের সাহিত্য ও অলংকার এবং ভাষাশৈলী দেখে আরবের কবিরা হতবাক হয়ে যায়। কেননা এমন মহিমাময় বাক্য তারা আগে কখনো শোনেনি। ফলে তারা যখন সুরা আদিয়াতের মতো ছন্দোবদ্ধ ও সাহিত্যোত্তীর্ণ সুরা শোনে, তখন তারা মুহাম্মদ (সা.)-কে কবি এবং কোরআনকে কবিতা ধারণা করে বসে, বরং কোরআন যখন মানুষের ওপর জাদুকরী প্রভাব বিস্তার করতে লাগল, তখন তারা নবীজি (সা.)-কে জাদুকর আখ্যা দিল। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি রাসুলকে কাব্য রচনা করতে শেখাইনি এবং এটা তার পক্ষে শোভনীয় নয়। এটা তো কেবল এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কোরআন।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৬৯)</p> <p>অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা এটাও বলে, এসব (কোরআনের আয়াতগুলো) অলীক কল্পনা, হয় সে তা উদ্ভাবন করেছে, না হয় সে একজন কবি। অতএব, সে আনুক আমাদের কাছে এক নিদর্শন, যেরূপ নিদর্শনসহ প্রেরিত হয়েছিল পূর্ববর্তীরা। তাদের আগে যেসব জনপদ আমি ধ্বংস করেছি তার অধিবাসীরা ঈমান আনেনি; তবে কি তারা ঈমান আনবে?’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৫-৬)</p> <p><strong>নবী (সা.)-এর প্রতি অপবাদ</strong></p> <p>কোরআন নাজিলের পর আরবে মুশরিক নেতা ও তাদের দোসর কবিরা মহানবী (সা.)-কে শুধু কবি বলেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং তারা তাঁকে গণক ও জাদুকর বলে অপবাদ দেয়। তাদের অপবাদের উত্তরে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই কোরআন এক সম্মানিত রাসুলের বাহিত বার্তা। এটা কোনো কবির রচনা নয়, তোমরা অল্পই বিশ্বাস করো। এটা কোনো গণকের কথাও নয়, তোমরা অল্পই অনুধাবন করো। এটা জগত্গুলোর প্রতিপালকের কাছ থেকে অবতীর্ণ।’ (সুরা : হাক্কাহ, আয়াত : ৪০-৪৩)</p> <p><strong>কবিদের প্রতি কোরআনের চ্যালেঞ্জ</strong></p> <p>মহান আল্লাহ কোরআনের একাধিক স্থানে আরবের কবি ও কাফির নেতাদের এই ভ্রান্ত দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি বলতে চায় সে একজন কবি? আমরা তার মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছি। ...তারা কি বলে, এই কোরআন তার নিজের রচনা? বরং তারা অবিশ্বাসী। তারা যদি সত্যবাদী হয়, তবে তার সদৃশ কোনো রচনা উপস্থিত করুক না!’ (সুরা : তুর, আয়াত : ৩০ ও ৩৩-৩৪)</p> <p><strong>কবিদের অক্ষমতা প্রকাশ</strong></p> <p>আল্লাহ শুধু সমকালীন কবি-সাহিত্যিক নয়, বরং কোরআনের সামনে কিয়ামত পর্যন্ত আসা সব কবি, সাহিত্য ও ভাষাবিদদের অক্ষমতা প্রকাশ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরূপ কোনো সুরা নিয়ে আসো এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তবে আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সব সাহায্যকারীর আহ্বান করো। যদি তোমরা নিয়ে না আসো এবং কখনোই করতে পারবে না, তবে সেই আগুনকে ভয় কোরো, মানুষ ও পাথর হবে যার ইন্ধন। অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৩-২৪)</p> <p><strong>ঈমানের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ</strong></p> <p>আল্লাহর অনুগ্রহে ধীরে ধীরে মানুষ বুঝতে পারে কোরআন কোনো মানুষের কথা নয়, কোনো কবির কবিতা নয়, কোনো গণকের ছন্দোবদ্ধ বাক্য নয়। আরবে ঈমানের আলো ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ কবিতার পরিবর্তে কোরআন তিলাওয়াত করতে শুরু করল। এর অর্থ ও মর্ম নিয়ে চিন্তা-গবেষণা শুরু করল। এমনকি কবিদের কাছেও কাব্যচর্চার চেয়ে কোরআনচর্চা প্রিয় হয়ে উঠল। কবি লাবিদ জাহেলি যুগের বড় কবি ছিলেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি কাব্যচর্চা ছেড়ে দিলেন। একবার ওমর (রা.) তাঁর কাছে ইসলাম গ্রহণের পরের কবিতা শুনতে চাইলেন। তখন তিনি তাঁর কাছে সুরা বাকারাহ লিখে পাঠিয়ে দেন। আল্লাহ তাআলা ইসলাম গ্রহণের পর আমাকে কবিতার পরিবর্তে এটা দান করেছেন। (কিতাবুল আগানি)</p> <p><strong>পার্থিব মোহের কাছে পরাজয়</strong></p> <p>অনেক কবি উপলব্ধি করেছিল কোরআন কোনো মানুষের কথা নয় এবং তা মানুষের পক্ষে রচনা করাও সম্ভব নয়। তবে তাদের বেশির ভাগ পার্থিব মোহের কাছে পরাজিত হয়। যেমন একবার আরবের বিখ্যাত ‘মুআল্লাকাতের’ (ঝুলন্ত কবিতা) একজন কবি আ’শা নবীজি (সা.)-এর দরবারে এসে তাঁর প্রশংসায় কবিতা পাঠ করতে চাইল। এই সংবাদ পেয়ে আবু সুফিয়ান (তখনো মুসলিম হননি) কুরাইশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের একত্র করে বলল, আল্লাহর শপথ! এই লোক যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যায় এবং তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে, তবে সে তার কবিতার মাধ্যমে সমগ্র আরবের আগুন তোমাদের বিরুদ্ধে উসকে দেবে। তোমরা তার জন্য ১০০ উট একত্র কোরো। তাঁর কথা অনুসারে কুরাইশ নেতারা ১০০ উট একত্র করে কবি আ’শাকে উপহার দিল এবং সে নিজ দেশের পথ ধরল। (কিতাবুল আগানি)</p> <p>আল্লাহ সবাইকে সত্য উপলব্ধি করার তাওফিক দিন। আমিন।<br />  </p>