<p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">চারতলা বাড়ির সব ওপরের ফ্ল্যাটে মাহিনরা থাকে। সেমি-অভিজাত পাড়া। বাসার সামনে পাড়ার রাস্তাটা প্রশস্তই, আগের কালের গলির মতো নয়। তবে গাড়ি-ঘোড়ার চল কম, যে দু-চারটা গাড়ি ছোটাছুটি করে, সেগুলোও পাড়ার লোকজনেরই। ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই রাস্তাসহ বাইরের চালচিত্র চোখের সামনে ফটোজেনিক হয়ে ওঠে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মাহিনের সংসারটা ছোট। তার স্বামী হাফিজ এজিবি অফিসে চাকরি করে। আবার ছোটখাটো একটা দোকানও দিয়েছে পাড়ারই মার্কেটে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার, ব্রা, পেটিকোটের। ইসলামপুর থেকে থানকাপড় কিনে পেটিকোট আর ব্লাউজগুলো মাহিনই তৈরি করে দেয়। তাদের একটাই মেয়ে এই এতটুকুন বেশ মিষ্টি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লিলি, সবাই ডাকে ললিপপ। ক্লাস সিক্সে পড়ে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তাদের সংসার শুরু হয় সেই কাকডাকা ভোর থেকে। তিনজনই আর্লিরাইজার। সবার আগে মাহিন। ফজরের আজানের আগে সে বিছানা ছেড়ে কিচেনে ঢোকে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">চুলায় হাঁড়ি-পাতিল চড়িয়ে গ্যাসের সুইচ ঘুরিয়ে দেয়। ব্রেকফাস্টের প্রাথমিক আয়োজন সেরে সে ওয়াশরুমে ঢোকে। এই সময় হাফিজের গাত্রোত্থান। সে হাত-পা ছড়িয়ে বারকয়েক মোচড় কেটে টেবিলের ওপর কাপে রাখা ভেজানো কাঁচা ছোলা মুখে দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। সারা মহল্লা একটা রাউন্ড দিয়ে ফিরে আসে তাদের বিল্ডিংয়ের সামনে। গেটের মুখেই শুরু হয় তার বুকডন-বৈঠকের পালা। এর মধ্যে উঠে পড়েছে ললিপপ। ঘরেই সে দুটি বিড়াল পালে। শুরু হয় ললিপপের বিড়াল পরিচর্যার পালা।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ব্রেকফাস্ট ডাইনিং টেবিলে গুছিয়ে মাহিন একটা পিরিচে মাছের এঁটো-কাঁটা, মুরগির হাড্ডিগুড্ডি এনে বিড়াল দুটির সামনে রাখে। তার ভুরু একটু কুঁচকাল। এ সময়টা লিলি বিড়ালের কাছেই থাকে। এখন তো দেখতে পাচ্ছে না!</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পিরিচটা বিড়ালদের কাছে রেখে সে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। ললিপপও এখানেই। মেয়ের মাথার ঝোঁকা চুল নেড়েচেড়ে বলল, কী রে ললিপপ! আজ বিড়ালগুলোকে কোনো আদর নেই?</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কথায় কান নেই ললিপপের। রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মা, ওই ফুটপাতে দেখো, কুকুরগুলোর পেটের সঙ্গে পেট লেগে রয়েছে। ওই ছেলেটা খাচ্ছে আর কুকুরগুলো তাকে ঘিরে ধরেছে। ছেলেটার একটুও মায়া-দয়া নাই।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কেউ হয়তো ফুটপাতে কলাপাতায় কুকুরদের জন্য কিছু খাবার দিয়ে গিয়েছিল। সেটাই কুকুরদের মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছেলেটা খাচ্ছে। চারটি কুকুর তার চারপাশে দাঁড়িয়ে হা-পিত্যেশ তাকিয়ে রয়েছে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ছেলেটার ওপর মাহিনের যেমন রাগ হলো, তেমনি মায়া লাগল কুকুরগুলোর জন্য।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ঘরের কোনা থেকে সে একটা লাঠি তুলে নিল। একটা টিনের থালা খুঁজে বের করে তাতে কয়েক মুঠো বাসি ভাত-তরকারি-সবজি নিল। নিজের হাতেই মাখিয়ে দিল। হাতটা ধুয়ে এক হাতে খাবারের থালা, আরেক হাতে লাঠিটা বাগিয়ে ধরে সিঁড়ি ভেঙে তরতর করে নেমে এলো নিচে। একেবারে সরাসরি ফুটপাতে কুকুরদের পাশে। গেট পেরিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিচে বুকডন-বৈঠকরত হাফিজ আড়চোখে বউয়ের রাগ-রাগ চেহারাটা দেখে নিয়ে একচিলতে মুচকি হাসল।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মাহিন যখন কুকুরদের পাশে, ছেলেটা তখন তার খাবার হরণ পর্ব সেরে খানিকটা দূরে এক বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালে হেলান দিয়ে আয়েশে বসে আছে। ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে মাহিনকেই দেখছে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">খাবারের থালা ও লাঠি হাতে পাশে মাহিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কুকুরদের মধ্যে একটি ভুক ভুক আওয়াজ উঠল</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এতে আনন্দ, না বিরক্তি প্রকাশ করল ঠিক বোঝা গেল না। কুকুরদের সামনে খাবারের থালা রাখতেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ছেলেটার দিকে শ্যেন দৃষ্টিপাত করে ফিরতি পথ ধরে কয়েক কদম ফেলতেই মাহিনের মনে সন্দেহ উঁকি দিল। থেমে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল, ছেলেটা ফুটপাতে হামাগুড়ি দিয়ে খাবারের থালার দিকে এগিয়ে আসছে।  </span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মাহিন লাঠি বাগিয়ে এগিয়ে যেতেই ছেলেটা দ্রুত পেছনে সরে গেল। কুকুরদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে লাঠি হাতে সেখানেই দাঁড়িয়ে পাহারা দিল। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে ঘরে ফিরে এলো।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রতিদিন সকালে কুকুরদের খাওয়ানো আর তাদের খাওয়া পাহারা দেওয়াই হলো তার নিত্যকর্ম।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সেদিন ভোরে কেন জানি সবারই ঘুম ভাঙতে বেশ খানিকটা দেরি হলো। আজ সবার আগে ঘুম ভেঙেছে হাফিজের। বাবাকে উঠতে দেখে ললিপপ বিছানায়ই উঠে বসে চোখ কচলাতে লাগল। মাহিন তখনো ঘুমাচ্ছে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হাফিজ ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গেল। বেশ বড়সড় হাই তুলে বাইরে তাকাল। সকালের দৃশ্যপটই আলাদা। নানা ধরনের পাখি তারস্বরে ডাকাডাকি করছে। মৃদু বাতাস। রাস্তার পাশে দু-চারটি গাছ যা আছে, তারা শহুরে হাওয়ায় একটু নড়েচড়ে উঠছে। রাস্তা এখনো ফাঁকা, লোকজনের হাঁটাচলা, গাড়ির দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়নি। চারপাশটাই শান্ত। ঘরের ভেতর থেকে এখন মাহিনের কর্মচাঞ্চল্য টের পাওয়া যাচ্ছে, ঘুম ভেঙেছে তাহলে। এ সময়ই হাফিজের নজর গেল বাসার সামনে ফুটপাতে। তার নজর সেখানেই স্থির হয়ে গেল। </span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ওদিকে মাহিন বোধ হয় ডাকাডাকি করছে। হাফিজ নিজেই ডাকল, ব্যালকনিতে এসো। দেখে যাও কাণ্ড। </span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শাড়ির আঁচলে ভেজা হাতটা মুছতে মুছতে মাহিন এলো। দেরি হয়ে গেছে, তাড়াহুড়া তার। বলল, কী হয়েছে? এখানে ডাকছ কেন?</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাবার স্বরে কিছু একটা ছিল, ললিপপও এসে দাঁড়াল ওদের পাশে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ফুটপাতেই নজর সবার। ছেলেটার হাতে গামলাভর্তি বিরিয়ানি। গরম ভাপ উঠছে। কেউ দিয়ে  েগছে বলে মনে হয় না, নিশ্চয়ই কোথাও থেকে, কোনো হোটেল থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছে। </span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গামলা নিয়ে ছেলেটা বসেছে ফুটপাতের ঠিক মাঝখানে। তাকে গোল করে ঘিরে রেখেছে চারটি কুকুর।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ছেলেটা গপাগপ কয়েক লোকমা নিজের মুখে তুলে নিল। তারপর একটা একটা করে লোকমা পাকিয়ে একেকটা কুকুরের মুখে তুলে দিতে লাগল।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেখে ওরা তিনজনই অভিভূত।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হাফিজ মাহিনকে বলল, এবার ছেলেটাকে কী বলবে? লাঠির ভয় দেখাবে?</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মাহিন চুপচাপ। তাকিয়ে আছে ফুটপাতেই।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লিলি বলল, থালার সংখ্যা বাড়ল। এবার আমাদের বাসা থেকে দুটি থালা যাবে ফুটপাতে। আমার মাকে আমি চিনি।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লিলি ভুল কিছু বলেনি। নিত্য ভোরে দুটি থালাই যায় ফুটপাতে। মাহিনের হাতে কোনো লাঠি থাকে না। থালা রেখেই সে সংসারের কাজে ফিরে আসে।</span></span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এমনই আরো এক ভোর। হাফিজ বাসার নিচে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজে ব্যস্ত। মাহিন বেশ আগেই ফুটপাতে খাবারের থালা দিয়ে গেছে। এখন চারতলায় ফিরে ডুবে গেছে সংসারের কাজে। লিলিই তাকে টানতে টানতে ব্যালকনিতে নিয়ে এলো। আঙুল তুলে দেখাল ফুটপাত। ছেলেটা কুকুরদের থেকে খানিকটা দূরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। খাবারের থালা দুটি কুকুরদের সামনে মাহিন যেমনই রেখেছিল, তেমনই আছে। কুকুরগুলো এখন দল বেঁধে পায়ে পায়ে ঠেলে ঠেলে থালা দুটি ছেলেটার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।</span></span></span></span></span></p> <p> </p>